
এক টুকরো কাগজকে মুড়ে কাগজের এরোপ্লেন বানানো, কিংবা একটা তারকে পাকিয়ে পাকিয়ে জোড়া-লাগা সাপের ঘোরানো আকৃতি দেওয়ার অর্থ পদার্থকে দুই থেকে তিন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া। একটা সিস্টেম কেমন আচরণ করবে তার উপর এই মাত্রা-বদলের লক্ষণীয় প্রভাব আছে। এই ঘটনাটা যদি ন্যানোস্কেলে ঘটে? ন্যানোস্কেল মানে হল একটা চুলের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। সেই পর্যায়ে গেলে কোয়ান্টাম পদার্থের একেবারে মৌলিক পর্যায়ের দৈর্ঘ্যর কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। সেই স্তরে ন্যানো-জ্যামিতির এমন সব ছাঁদ পাওয়া যায় যা ওই পদার্থর ধর্মই বদলে দিতে পারে। তার ওপর যদি ত্রিমাত্রিকতায় পৌঁছনো যায়, তখন তো প্রয়োজন অনুসারে তাকে কেটেছেঁটেও নেওয়া যায়। প্রতিসমতা ভেঙে দিয়ে, বক্রতা ঢুকিয়ে দিয়ে, পরস্পর-সংযুক্ত চলনপথ সৃষ্টি করে কোয়ান্টাম পদার্থের ক্রিয়াশীলতাগুলোকেই বদলে ফেলা যায়। কাজটা খুবই কঠিন।
কিন্তু সেই প্রায়-অসাধ্যসাধনই করেছেন মাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর কেমিক্যাল ফিজিক্স অব সলিড্স-এ জার্মানি আর অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী। তাঁরা ত্রিমাত্রিক ন্যানো-প্রিন্টারের মতো এক প্রকৌশল কাজে লাগিয়েছেন। সেতু-সদৃশ এক অতি-পরিবাহীর অতিপরিবাহী দশার উপর স্থানীয় স্তরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তাঁরা। এমনকি তিন মাত্রায় অতিপরিবাহী ঘূর্ণির চলনও দেখাতে পেরেছেন। সম্প্রতি অ্যাডভান্সড ফাংশনাল মেটিরিয়ালস পত্রিকায় এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে।
এই চমকপ্রদ আচরণের মূলে আছে ‘কুপার-জুড়ি’র ক্রিয়া। কুপার-জুড়ি মনে কী? দুটি বদ্ধ ইলেকট্রনের জুড়ি যখন বিনা বিচ্ছুরণে বিনা প্রতিরোধে সুশৃঙ্খলভাবে পদার্থর মধ্য দিয়ে ঘোরাফেরা করে, তখন তাকে বলে কুপার-জুড়ি। ত্রিমাত্রিক ন্যানোজ্যামিতির ছাঁদ রচনা করবার সময় গবেষকরা ন্যানোকাঠামোর বিভিন্ন অঙ্গে অতিপরিবাহিতার ‘সুইচ’ বন্ধ করে দিতে পেরেছেন। একদিকে অতিপরিবাহী দশা, অন্যদিকে “স্বাভাবিক” দশার এই সহাবস্থান থেকে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানসম্মত নানারকম ক্রিয়ার জন্ম হতে পারে। যেমন তথাকথিত ‘ক্ষীণ গ্রন্থি’, যা চরম সংবেদি সেন্সিং-এ কাজে লাগে। কোনোকিছুর ভৌত উপস্থিতি শনাক্ত করে সেই উপাত্তকে (ডেটা) একটি যন্ত্র-পাঠ্য সংকেতে পরিণত করে এটি। এতদিন পর্যন্ত এই ধরণের নিয়ন্ত্রণ আনতে গেলে আগে থেকে ওই দুটি দশার সহাবস্থানের উপযুক্ত কাঠামো তৈরি রাখতে হত। কিন্তু এই গবেষণায় দেখা গেল, কাঠামোটাকে একটা চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে রেখে ঘোরালেই ত্রিমাত্রিক কাঠামোটির বিভিন্ন অঙ্গের অতিপরিবাহী দশার সুইচ চালানো বা বন্ধ করা যায়। এইভাবে এমন এক অতিপরিবাহী যন্ত্রকৌশল বানানো গেল যাকে “পুনঃ-নকশায়িত” করা যায়।
এই পুনঃ-নকশায়ন ক্রিয়া থেকে এবার একটা নতুন মঞ্চ তৈরি হবে , যার সাহায্যে অভিযোজনক্ষম কিংবা বহু-কর্মা অতিপরিবাহী অঙ্গ বানানো সম্ভব হবে। ফলে জটিল অতিপরিবাহী যুক্তিপ্রবাহ (লজিক) আর স্নায়ু-কাঠামোর স্থাপত্য গড়ে তুলে পুনঃ-নকশায়ন-যোগ্য অতিপরিবাহী প্রযুক্তির এক নতুন প্রজন্মর দুয়ার খুলে যাবে।