
পাখিরা প্রতি বছর হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়, নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ছাড়াই। এই বিস্ময়কর প্রব্রজন কীভাবে পরিচালিত হয়, তা বিজ্ঞানীদের অনেকদিন ধরেই ভাবাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, পাখিরা হয়তো কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ও বিজড়িত দশার (এন্টাঙ্গলমেন্ট) মতো জটিলতা ব্যবহার করে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র অনুভব করে এবং তার সাহাযে দিক নির্ধারণ করে। কোয়ানটাম বিজড়িত দশায় একটি কণার অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে তা অন্য কণার অবস্থার উপর তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব ফেলে, যদিও তাদের মধ্যে কোনো ভৌত যোগাযোগ থাকে না।
জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব ওল্ডেনবার্গ-এর ড. জিংজিং জু বলেন, রাতের বেলা অভিবাসী গায়ক পাখিরা অত্যন্ত দক্ষ পথ নির্দেশক। এই দক্ষতার পেছনে আছে এক ধরনের প্রোটিন—ক্রিপ্টোক্রোম । এটি একটি আলো-সংবেদি প্রোটিন, যা পাখির চোখে থাকে। এটি ইলেকট্রনের ঘূর্ণায়মান অবস্থায় পরিবর্তনের মাধ্যমে চৌম্বক সংকেত পাঠাতে পারে।গবেষণায় বলা হয়, “ৱ্যাডিক্যাল পেয়ার মডেল” নামক একটি কোয়ান্টাম পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞানের একটি ধারণা যা একটি নির্দিষ্ট ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া বা ঘটনার ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। এই মডেলটিতে, দুটি মুক্ত মূলক (ৱ্যাডিক্যাল )একে অপরের সাথে জোড়া বেঁধে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এতে জড়িত থাকে দুইটি ইলেকট্রন, যাদের স্পিন পরস্পরের সাথে বিজড়িত থাকে। মানে একটির অবস্থানের পরিবর্তন অন্যটির ওপর প্রভাব ফেলে, তারা আলাদা জায়গায় থাকলেও। এই পরিবর্তন পাখির দৃষ্টিপথে রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে পৌঁছে যায়, যা তাদের যাত্রাপথের অভিমুখ নির্ধারণে সহায়তা করে।এই প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র দিনের আলোতে সক্রিয় হয়, বিশেষ করে পাখির চোখের অতিবেগুনি সংবেদি কোষগুলিতে অবস্থিত CRY4 নামে একটি বিশেষ ধরণের ক্রিপ্টোক্রোমের মাধ্যমে। এর গঠন এমন, যা আলোর সংবেদনশীল অংশগুলিকে স্থিতিশীল রাখে এবং কার্যকর সংকেত পাঠাতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক অভিবাসী পাখি মাথা নাড়িয়ে আশেপাশের চৌম্বক পরিবর্তন বোঝে। এটি সম্ভবত পাখিদের অন্তর্নিহিত দিকনির্দেশক ব্যবস্থার অংশ। বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, অভিবাসী পাখিরা সামান্য চৌম্বক পরিবর্তনেও প্রতিক্রিয়া জানায়, যা অন্যান্য স্থির জীবনধারার পাখিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
পূর্বে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, পাখির ঠোঁটে থাকা ম্যাগনেটাইট কণাই হয়তো এই অনুভূতির জন্য দায়ী।এখন কিন্তু ক্রিপ্টোক্রোম-ভিত্তিক মডেলটি বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, কারণ এটি আলো ও চৌম্বকক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারে।
তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। যেমন, কীভাবে এত ছোট কোষ-প্রোটিন এত দুর্বল চৌম্বক সংকেত বুঝে ফেলে। এই রহস্য এখনো জটিল। মানুষের মধ্যেও কি এর কোনো ছাপ আছে? আর অন্য প্রাণীরাও কি এমন অনুভূতি রাখে?
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, এই প্রক্রিয়াটি শুধু পাখিদের পরিযানে সাহায্য করে না, বরং আমাদের প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও দেয়। যদি এই ব্যবস্থাকে ভালোভাবে বোঝা যায়, তবে তা সংরক্ষণ ও প্রযুক্তিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।এভাবে দেখা যাচ্ছে, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা শুধু ল্যাবেই সীমাবদ্ধ নয়, জীবজগতে বিশেষ করে পাখির চোখে, তার কার্যকারিতা বিস্ময়করভাবে প্রমাণ করছে। এই গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়,প্রকৃতি অনেক গোপন রহস্য ধারণ করে যা, আমরা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছি।