সময় শুধু সামনের দিকেই ‘বহিয়া যায়’ কেন?

সময় শুধু সামনের দিকেই ‘বহিয়া যায়’ কেন?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৩ জুন, ২০২৫

কিছু কিছু স্মৃতি সারা জীবন অটুট থাকে, কিছু যায় মলিন হয়ে। কেন এমন হয়? নতুন এক গবেষণা হয়তো এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ব্যাপারে পথ দেখাতে পারে। তাপগতিবিদ্যা (থার্মোডিনামিক্‌স)-অনুপ্রাণিত একটি নতুন কাঠামো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে চেয়েছেন কীভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল একযোগে কাজ করে আমাদের বোধবুদ্ধিকে গড়ে তোলে।
তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, যাবতীয় সজীব সিস্টেম সাম্যাবস্থাকে অনেক দূরে রেখে কাজ করে। আর তারই ফলে “সময়ের তির”-এর উদ্ভব। এর গতিশীল দশা সময়ের গতিকে উলটোমুখে ফিরতে দেয় না। পরিভাষায় এ-কে বলে ‘অনুৎক্রম্যতা’ (ইরিভার্সিবিলিটি)। মানুষের মস্তিষ্ক এর ব্যতিক্রম নয়। বস্তুত মানুষের মস্তিষ্ক এমন অতুলনীয় রকমের জটিল এক সিস্টেমের দৃষ্টান্ত যা অনেকগুলি বিশেষ কাজে পটু অংশের মধ্যে অজস্র আন্তঃক্রিয়া ঘটায়। স্নায়ুঘটিত ক্রিয়াকর্মে সময়ের অভিমুখ কখনো ফেরানো যায় না – এই ঘটনাটিকে কাজে লাগিয়ে, মস্তিষ্কের কতকগুলি সর্বপ্রধান অঞ্চলকে শনাক্ত করা সম্ভব যাদের আন্তঃক্রিয়া বোধবুদ্ধির বিকাশ ঘটায়। তাপগতিবিদ্যা এ গবেষণাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন আন্তঃক্রিয়ার নানা স্তর জুড়ে স্নায়ুক্রিয়ার রেকর্ডিংগুলির অনুৎক্রম্যতা (ইরিভার্সিবিলিটি) পরিমাপ করার একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষায় কয়েকজন মানুষকে একটা দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিনির্ভর কাজ করতে বলা হয়। একটা সুর অল্প কিছুক্ষণ শুনিয়ে তার বিভিন্ন রকমফের শনাক্ত করতে বলা হয় তাদের। যখন তারা সুরটাকে ঠিকঠাক শনাক্ত করতে পারে তখন তাদের মস্তিষ্কের গতিময়তা একটি বিশেষ যন্ত্রকৌশলে রেকর্ড করা হয়। সেই রেকর্ডিংগুলিকে বিশ্লেষণ করে এবার মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের অনুৎক্রম্যতার পরিমাণাত্মক মাত্রা মাপা হয়। অবাক-করা ফলগুলি থেকে বোঝা গেল, এই পদ্ধতিটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর গুরুত্বহীন আন্তঃক্রিয়াগুলিকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারছে।
বহু-বিষয় সমন্বিত এই গবেষণাটি চালিয়েছেন অক্সফোর্ড, আরহাস আর পম্পিউ বিশ্ববি্দ্যালয়ের গণিতজ্ঞ আর স্নায়ুবিজ্ঞানীরা। এঁদের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, কার্য-কারণ সম্পর্কে আবদ্ধ আন্তঃক্রিয়াগুলির অনুৎক্রম্যতা, কার্য-কারণ সম্পর্কহীন আন্তঃক্রিয়াগুলির তুলনায় বেশ অনেকটা বেশি। প্রথমটি উদাহরণ হল সংবেদ-অঞ্চল আর প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের আন্তঃক্রিয়া। আর দ্বিতীয়টির উদাহরণ হল এক জোড়া সংবেদ-অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া। অর্থাৎ যেসব আন্তঃক্রিয়ার মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক যত বেশি তাদের অনুৎক্রম্যতা তত বেশি, তারা তত বেশি একমুখী, তাদের গতিমুখ ফেরানো যায় না। এর থেকে বোঝা গেল, মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধের মধ্যে যোগাযোগকে স্বচ্ছন্দ করে তুলে মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলি দীর্ঘমেয়াদি শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে সুসমন্বিত করার কাজে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এ গবেষণার ফল থেকে এই কথাটাই বেরিয়ে এসেছে যে রাশিতাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা আর হাতিয়ারগুলি প্রয়োগ করে মানুষের মস্তিষ্কের আন্তঃক্রিয়ার গতিময় কাঠামোগুলি সম্বন্ধে রোমাঞ্চকর ও অভিনব অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা সম্ভব। কানে শুনে মস্তিষ্ক কীভাবে কোনো কিছু শনাক্ত করে সেই প্রক্রিয়াটাকেও এর সাহায্যে আরও উন্নতভাবে বোঝা গেছে। এখানেই বহু বিষয়-সমন্বিত গবেষণার সাফল্য।
পি এন এ এস পত্রিকায় সম্প্রতি এ গবেষণার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − 14 =