নীরব ভূকম্পনের কাহিনী

নীরব ভূকম্পনের কাহিনী

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ জুন, ২০২৫

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর। হঠাৎ বিশ্বজুড়ে ধরা পড়ল এক রহস্যময় ভূকম্পন সংকেত। টানা ৯ দিন প্রতি ৯০ সেকেন্ড অন্তর অন্তর চলল স্পন্দন। এরপর এক মাসের বিরতি। আবারও ফিরে এল সেই একই কম্পন। বিজ্ঞানীরা হতবাক। ভূমিকম্প নয়, আগ্নেয়গিরিও নয়, তবেএমন নিয়মিত স্পন্দনের উৎস কোথায়? প্রায় এক বছর পর, দুইটি পৃথক বৈজ্ঞানিক গবেষণা জানা গেল এক বিস্ময়কর তথ্য- এই কম্পনের উৎস পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের এক নির্জন খাঁড়িতে দুটি বিশাল সুনামি। হিমবাহ গলে তৈরি হওয়া ভূমিধসে সৃষ্টি হয় এই ঢেউ, যেগুলো খাঁড়ির সীমানার মধ্যে আটকা পড়ে একধরনের ‘স্থির ঢেউ’ বা ‘seiche’ তৈরি করে, যা বারবার খাঁড়ির এক দিক থেকে অন্যদিকে ঘুরে ফিরে কাঁপাতে থাকে মাটি। তবে দীর্ঘদিন এসব ঢেউ ছিল অদৃশ্য। এমনকি প্রথম সুনামির তিন দিন পর ডেনিশ সামরিক জাহাজ ঐ খাঁড়িতে পৌঁছেও কিছু টের পায়নি! কারণ, প্রচলিত স্যাটেলাইট অ্যালটিমিটার প্রযুক্তি সমুদ্রপৃষ্ঠের কেবল সরলরৈখিক উচ্চতা রেকর্ড করে। তবে এই প্রযুক্তি এমন ঢেউ চিহ্নিত করতে অক্ষম। এই রহস্য উদ্ঘাটনে সাহসী পদক্ষেপ নেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তারা ব্যবহার করেন এক নতুন প্রজন্মের উপগ্রহ -SWOT (Surface Water Ocean Topography) । ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটিকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এতে রয়েছে এমন এক রেডার ইন্টারফেরোমিটার যার দুটি অ্যান্টেনা উপর গ্রহর দুই পাশে বসানো—প্রায় ১০ মিটার দূরে। এটি এমন এক শক্তিশালী রেডার সিস্টেম, যা স্যাটেলাইট থেকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর দিকে রেডার পাঠিয়ে, তাদের ফিরে আসা সংকেতের পার্থক্য বিশ্লেষণ করে জল বা স্থলের অতি সূক্ষ্ম উচ্চতা ও ঢেউ বুঝতে পারে। এই অ্যান্টেনা জুটি একসাথে কাজ করে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে জলের উচ্চতা পরিমাপ করতে পারে ২.৫ মিটার রেজোলিউশন পর্যন্ত, এবং একসাথে ৫০ কিমি এলাকা জুড়ে এটি এমন পরিমাপের কাজ করতে পারে। এই SWOT তথ্য ব্যবহার করে গবেষকরা গ্রিনল্যান্ডের খাঁড়িতে উঁচু-নিচু ঢেউয়ের মানচিত্র তৈরি করেন। তাতে দেখা যায়, কখনো জল পূর্বদিকে ঝুঁকে পড়ছে, আবার কখনও পশ্চিমদিকে। সুতরাং স্পষ্ট প্রমাণ, খাঁড়ির মধ্যে জল ঘুরপাক খাচ্ছে, আর তারই ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ভূকম্প তরঙ্গ। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়, এই ঢেউয়ের প্রভাব ধরা পড়েছে পৃথিবীর হাজার কিলোমিটার দূরের ভূত্বকের মৃদু আন্দোলনে। যেন এক অদ্ভুত দূরভৌতিক সংযোগ! গবেষণার প্রধান লেখক টমাস মোনাহান বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমন চরম ঘটনা জন্ম নিচ্ছে, যা ধরতে গেলে আমাদের দরকার পরবর্তী প্রজন্মের স্যাটেলাইট প্রযুক্তি।” সহ-লেখক অধ্যাপক টমাস অ্যাডককের ভাষায়, “আগামী দিনে সুনামি, স্টর্ম সার্জ বা দৈত্যাকার ঢেউ বোঝার জন্য এই প্রযুক্তি এক যুগান্তকারী হাতিয়ার হবে।” তবে ভাবতেই অবাক লাগে, সীমানা ছাপিয়ে ফিয়র্ডে জমে থাকা গোপন ঢেউ লাগাতার কাঁপিয়ে গেল গোটা বৈজ্ঞানিক বিশ্বকে!

(এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য, ‘গ্রিনল্যান্ডে গুরুতর সুনামি ‘, ১৬ জুন ২০২৫)

https://bigyanbhash.org/%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 + three =