
আমরা যেভাবে বিশ্বকে দেখি সেটা শুধু আমাদের দৃষ্টিশক্তির ওপরেই নির্ভর করে না, বরং পরিপার্শ্ব ও সংস্কৃতিও তাকে প্রভাবিত করে। এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এক শতকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন, কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যে-দৃষ্টিবিভ্রম ব্রিটেন ও আমেরিকার মানুষকে ধোঁকা দেয়, নামিবিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিম্বা জনগোষ্ঠীর মানুষরা সেটি ঠিকই দেখতে পায় । এমনকি যেখানে একটি চিত্রর ঠিক-ভুল যাচাই করার কোনও মানদণ্ড নেই, সেখানে হিম্বারা যা দেখেন তা প্রায়শই শিল্পোন্নত সমাজের লোকেদের থেকে অনেক আলাদা।
এ প্রসঙ্গে ‘কফার বিভ্রম’ নামক দৃষ্টিবিভ্রমটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এটি তৈরি করেছিলেন অ্যান্টনি নর্সিয়া নমে এক দৃষ্টি-বিজ্ঞানী। তাতে একটি দ্বিমাত্রিক চিত্র কিংবা ত্রিমাত্রিক বস্তুকে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে দেখা যায়। তার একটি কোণের সঙ্গে অন্যটির বিস্তর তফাত। একটি শিক-জালের (গ্রিড) ছবিতে কেউ দেখেন আয়তক্ষেত্র, কেউ দেখেন বৃত্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটেন ও আমেরিকার ৯৭% মানুষ প্রথমে দেখেন আয়তক্ষেত্র, কিন্তু হিম্বা গ্রামের ৯৬% মানুষ প্রথমে দেখেন বৃত্ত। গবেষকরা মনে করেন, এর পেছনে রয়েছে ‘ ছুতোরের হাতে-বানানো জগৎ’ (“Carpentered world hypothesis”) নামক এক তত্ত্বপ্রস্তাব। তাতে বলা হয়, শহুরে মানুষ চারকোনা ভবনের মধ্যে বাস করে বলে তারা অবচেতনভাবেই আয়তক্ষেত্র বেশি দেখে। অপরদিকে, হিম্বা জনগোষ্ঠীর গ্রামগুলো মূলত গোলাকার কুটির ও গোল পশুখামার নিয়ে গঠিত, তাই তারা বৃত্তকে বেশি দ্রুত চিনতে পারে । গবেষণায় আরও ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিবিভ্রমের মারফত দেখা গেছে, কৃষ্টি ও প্রতিবেশ আমাদের প্রাথমিক দেখার অভ্যাসকে গড়ে তোলে। শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ অনেক ক্ষেত্রে সহজেই বিভ্রান্ত হন, কিন্তু গ্রামীণ পরিবেশে বসবাসকারী মানুষ প্রকৃত আকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকেন। যেমন উত্তর নামিবিয়ার হিম্বা জাতির এক মহিলা উয়াপোয়ানাওয়া বৃত্তাকার আর আয়তাকর দুরকম আকারই সহজে দেখতে পেয়েছেন। তাঁর গ্রামে তিনি দুরকম আকৃতির বস্তুই দেখেছেন। তিনি অবাক হয়ে বলেছেন, “আপনারা গোল আকারটা দেখতে পাচ্ছেন না? কী আশ্চর্য!”
এই গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, শুধু একটি অঞ্চলের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মানুষকে বোঝার চেষ্টা করলে বড় ভুল হতে পারে। মনস্তত্ত্ব বা দৃষ্টিবিজ্ঞান বুঝতে বৈচিত্র্য ও কৃষ্টিগত পার্থক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। গবেষকরা ভবিষ্যতে এই পার্থক্যের কারণ আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করার পরিকল্পনা করছেন