আলো-অন্ধকার

আলো-অন্ধকার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১০ জুলাই, ২০২৫

একুশ শতক। রাতের অন্ধকারেও এখন থাবা বসিয়েছে লোকালয়ের আলো। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় Artificial Light At Night, অ্যালান, বা রাতের কৃত্রিম আলো। আলো না বলে আলোক দূষণ কথাটা এখানে যথোপযুক্ত। এই ‘আলো’ নিয়ে চলেছে এক বিস্ময়কর গবেষণা। রাতের কৃত্রিম আলো আরও ভয়াবহভাবে এলোমেলো করে দেয় শরীরের জৈব ঘড়ি। রয়্যাল সোসাইটি-তে প্রকাশিত এই গবেষণায় জেব্রাফিঞ্চ পাখিদের উপর চালানো হয় এক অভিনব পরীক্ষা। প্রাণীদের জৈব ঘড়ি এই কৃত্রিম রাত-আলোর দ্বারা প্রভাবিত হয় অনেকখানি। তবে, আগের বেশিরভাগ গবেষণা একাকী প্রাণীর উপর করা হয়েছিল। এই গবেষণায় ১০৪টি পাখিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একদল পাখিকে একা একটি খাঁচায় রাখা হয়। অন্য দলকে ছোট ছোট ছয়-পাখির দলে (৩ পুরুষ + ৩ নারী) ভাগ করা হয়। প্রথম তিন সপ্তাহ তাদের রাখা হয় প্রাকৃতিক দিনের ছন্দেই – ১২ ঘণ্টা আলো, ১২ ঘণ্টা অন্ধকার। এরপর প্রতিটি দলকে আবার দুই ভাগে ভাঙা হয়: একটি অংশকে রাতের কৃত্রিম আলোর মধ্যে রাখা হয় আর অন্যটিকে স্বাভাবিক আলোয়। অ্যালান দলের উপর রাতের বেলায় ফেলা হয় ৫ লাক্স মাত্রার আলো। দিনের আলো (৬৭৫ লাক্স)-এর তুলনায় এটি অনেক কম, কিন্তু শহরের আলো দূষণের সমতুল্য। গবেষকরা ক্যামেরা আর যন্ত্রাংশ দিয়ে পাখিদের নজরে রাখেন। তারা কে কত লাফালাফি করছে, কখন ঘুমোচ্ছে, কখন জেগে উঠছে। দেখা ডিলেট, অ্যালান-এর শিকার সব পাখিই রাতজাগা হয়ে উঠল। তবে একা থাকা পাখিদের চেয়ে সামাজিক পাখিরা অনেক বেশি উন্মত্ত, অস্থির, এবং দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস এবং লিভারে জিন বাহ্য প্রকাশের ধরণও বদলে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় জৈব ঘড়ি, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে শরীর। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই বিশৃঙ্খলায় ‘মেলাটোনিন ’ হরমোন মাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন ধরা পড়েনি। অর্থাৎ ঘুমের রাসায়নিক নির্দেশ ঠিক থাকলেও, আচরণ ভীষণভাবে পাল্টে গেছে। আরও খেয়াল করা গেছে, দলবদ্ধভাবে থাকা পাখিরা আলোতে বেশি সংবেদনশীলতা দেখায়। কারণ এরা একে অপরের আচরণকে প্রভাবিত করে। একজন জেগে উঠলেই, বাকিরাও জেগে ওঠে আলোর জন্য নয়, বরং সামাজিক উদ্বেগের কারণে। গবেষকরা বলেন, ভবিষ্যতে আরও কম আলোতেও এমন প্রতিক্রিয়া ঘটে কিনা তা নিয়ে গবেষণা দরকার। কারণ, এই আলো শুধু রাত নয়, জীববৈচিত্র্যের মনেও থাবা বসাচ্ছে। সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার শুধু পাখির জৈব-ঘড়িই না, আমাদের শহরের কৃত্রিম আলোক-দূষণ নিয়েও প্রশ্ন তোলে। আমরা কি তাহলে আলোর নামে আঁধার ছড়িয়ে দিচ্ছি? কৃত্রিম আলোক-দূষণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বোঝা এখন সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − six =