মানব ডিম্বাণুর হাল হকিকত

মানব ডিম্বাণুর হাল হকিকত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ আগষ্ট, ২০২৫

ডিম্বাণু হলো নারীর প্রজনন কোষ, যা নিষিক্ত হলে নতুন জীবনের সূচনা হয়। এটি মানবদেহের সবচেয়ে বড় কোষ যার ব্যাস ১০০ মাইক্রোমিটার। ফলে একে খালি চোখেও দেখা যায়।

নারীশরীরে ডিম্বাণু জন্মের আগেই তৈরি হয়। এই ডিম্বাণু দশকের পর দশক, কমপক্ষে ৪০ বছর অব্দি ডিম্বাশয়ে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থেকে যেতে পারে – যতক্ষণ না তা নতুন জীবনের সূচনার জন্য ব্যবহৃত হয়। বার্সেলোনার সেন্টার ফর জেনোমিক রেগুলেশনের ড. এলভান বোকে ও তাঁর দল গবেষণায় দেখেছেন, ডিম্বাণুগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের প্রস্তুতি সর্বদা চালিয়ে যায় ধীরে ধীরে। অর্থাৎ ডিম্বাণুরা নিজেদের বিপাকক্রিয়া ও কোষগত কার্যক্রম ধীর করে নিজেদের শক্তির খরচ কমিয়ে “কম শক্তি খরচের পন্থা” অবলম্বন করে, যাতে তারা দীর্ঘদিন ক্ষয়প্রাপ্ত না হয়ে টিকে থাকতে পারে। ঠিক যেমন স্মার্টফোনের ব্যাটারি সেভার মোড শক্তি বাঁচিয়ে যন্ত্রটিকে দীর্ঘ সময় সচল রাখে।

নারীর জন্ম হয় এক থেকে দুই মিলিয়ন অপরিপক্ব ডিম্বাণু নিয়ে। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র কয়েকশো ডিম্বাণুই জীবনের কোনো এক সময় পরিপক্ব হয়ে ডিম্বস্ফোটনের জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিনের বিপাকক্রিয়া থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থ ডিএনএ, ঝিল্লি ও প্রোটিন যাতে একে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে, তার জন্য ডিম্বাণুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও রয়েছ । তার মূল উপাদান হল লাইসোজোম ও প্রোটিওসোম, যাৱা সাধারণত পুরনো অংশ ধ্বংস করতে দেয়। ফলে তৈরি হয় ক্ষতিকর রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিসিস (আর ও এস)।
গবেষণায় দেখা গেছে, ডিম্বাণুতে মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যক্রমসহ এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া ধীর গতিতে চলে। যাতে রস কম তৈরি হয় এবং ডিম্বাণু বেশি দিন অক্ষত থাকে। বোকে’র দল আরও দেখতে পান, ডিম্বস্ফোটনের আগে ডিম্বাণুর লাইসোজোমগুলো কোষের বর্জ্য গুলোকে কোষের কিনারায় নিয়ে গিয়ে বাহিরে ফেলে দেয় — যেন এক ধরণের “ঘর সাফাই ” প্রক্রিয়া। এর কথা আগে জানা ছিল না। সজীব কোষের ছবি তুলে দেখা গেছে, ডিম্বস্ফোটনের আগে মাইটোকন্ড্রিয়া ও প্রোটিওসোম নিয়ে ডিম্বাণু কোষের কিনারায় বলয় তৈরি করে নিজের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা আরও কমিয়ে ফেলে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা গেছে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ২৬ লক্ষ ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আই ভি এফ ( মানবদেহের বাইরে নিষিক্তকরণের পদ্ধতি বিশেষ) প্রচেষ্টা হয়, যার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারণ ব্যর্থ হয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ নিম্নমানের ডিম্বাণু। গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে পরিপক্ব করা ডিম্বাণুতে বিপাকক্রিয়ার ভারসাম্য ঠিক না থাকায় সফলতার হার কমে যায়।

বোকে’র গবেষণায় প্রাপ্ত নতুন তথ্য বলছে, প্রকৃতিতে ডিম্বাণুগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকে ও কম শক্তি ক্ষয় করে, ততক্ষণ তাদের মান ভালো থাকে। তাই গবেষকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ডিম্বাণুকে উদ্দীপিত করে তোলার বদলে তার প্রাকৃতিক নীরব অবস্থাকে ধরে রাখাই হতে পারে সফল আই ভি এফ-এর চাবিকাঠি। তবে এই পদ্ধতির জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন, কারণ অত্যধিক কম শক্তির ব্যবস্থাপনাও ক্ষতিকর হতে পারে।

পরবর্তী ধাপে গবেষকরা ঠিক করেছেন ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ডিম্বাণু এবং ব্যর্থ আই ভিএফ-এর ক্ষেত্রে সংগৃহীত ডিম্বাণু বিশ্লেষণ করবেন। তাঁরা দেখতে চাইবেন, বয়স বা রোগের কারণে ডিম্বাণুর এই “কম শক্তি খরচের ” পন্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিনা। এতে বয়সজনিত বন্ধ্যাত্বের নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বার খুলতে পারে।

এছাড়া বিজ্ঞানীরা জানতে চান কীভাবে ডিম্বাণু বুঝতে পারে কখন বর্জ্য ফেলার বা মাইটোকন্ড্রিয়ার অবস্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। এর উত্তর ভবিষ্যতে মানব ডিম্বাণুর মান যাচাইয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে।

তথ্যসূত্রঃ The EMBO Journal ;(20.7.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 1 =