সাগরতারকাদের গণমরণ ও পুনর্জন্ম

সাগরতারকাদের গণমরণ ও পুনর্জন্ম

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ আগষ্ট, ২০২৫

২০১৩ সালে উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার উপকূলে হঠাৎ করে এক বিপর্যয় দেখা দেয়। ওয়াশিংটন রাজ্যের উপকূলবর্তী জলসীমায় তারা মাছ বা স্টার ফিশ -দের মধ্যে এক অজানা রোগের দ্রুত বিস্তার শুরু হয়। শরীর বিকৃত হয়ে পড়ে, বাহু মুচড়ে যায়, দেহ দ্রুতপচনশীল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। কয়েক মাসের মধ্যেই ২০টির বেশি প্রজাতি আক্রান্ত হয়। কোটি কোটি তারা মাছের মৃত্যু ঘটতে থাকে। এই ঘটনা ‘সামুদ্রিক তারা মাছের ক্ষয় রোগ’ নামে পরিচিত। অবশ্য ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়া ও মেক্সিকোতেও এ ধরনের আক্রমণ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ২০১৩–১৪ সালের রোগটা ছিল ভিন্ন মাত্রার। এটি আলাস্কা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিবেশগত প্রভাব ছিল নজিরবিহীন। সূর্যমুখী সী স্টার (Pycnopodia helianthoides), যাদের ২৪টি বাহু ও প্রায় ১ মিটার ব্যাসের দেহ থাকতে পারে, সেগুলি এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। হাকাই ইনস্টিটিউট- এর অ্যালিসা-লুইস গেম্যান ও সহকর্মীরা ২০১৮ সাল থেকে এই রোগের কার্যকারণ অনুসন্ধানে নেমে পড়েন। প্রথমদিকে এটি ভাইরাসজনিত কোনো রোগ বলে সন্দেহ করা হয়।
গবেষকরা প্রথমে অসুস্থ সী স্টারের কোষকলা থেকে ভাইরাস ছাড়া অন্য সব কণা ফিল্টার করে নিয়ে, সুস্থ তারা মাছের দেহে প্রয়োগ করেন। তাতে কোনো সংক্রমণ দেখা যায়নি। এরপর কোষকলার সব উপাদান অপরিবর্তিত রেখে প্রয়োগ করলে, তাদের সংক্রমণ ঘটে। পরবর্তী পরীক্ষায় দেখা যায়, শুধুমাত্র দেহতরল প্রয়োগেই সংক্রমণ ঘটছে। কিন্তু জীবাণুমুক্ত দেহ তরল এই সংক্রমণ ঘটাতে ব্যর্থ। যার থেকে স্পষ্ট হয়, ‘এর মূলে রয়েছে কোনো জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া’। মেলানি প্রেন্টিস অসুস্থ ও সুস্থ তারা মাছগুলির দেহতরলের মেটাজেনোমিক সিকোয়েন্সিং করেন। এ একটি জিনগত বিশ্লেষণ পদ্ধতি। এতে কোনো পরিবেশগত নমুনা (যেমন মাটি, জল, তারা মাছের টিস্যু, অন্ত্রের তরল ইত্যাদি) থেকে যাবতীয় জীবাণুর ডিএনএ একসাথে সংগ্রহ করে তাদের জিনগত পর্যায়ক্রম বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা যায়, অসুস্থ নমুনাগুলির ব্যাকটেরিয়া ডিএনএর অধিকাংশই Vibrio (বাঁকা-আকৃতির ব্যাকটেরিয়া) গণভুক্ত, যার মধ্যে প্রধান হল Vibrio pectenicida strain FHCF-3.
এই ব্যাকটেরিয়া পূর্বে ফ্রান্সে, স্ক্যালপ ও ওয়াশিংটনে সামুদ্রিক শামুক লার্ভায় দেখা গিয়েছিল। গবেষকদল আগেকার নমুনা পুনঃবিশ্লেষণ করে আলাস্কায় ২০১৬ সালে এই ব্যাকটেরিয়া প্রজনের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। তাঁরা পরীক্ষাগারে এই প্রজনটিকে আলাদা করে ল্যাবরেটরির কৃত্রিম পরিবেশে পরীক্ষা করতে সক্ষম হন। এরপর, গবেষকরা সুস্থ তারামাছের শরীরে তিনটি মাত্রায় (নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ) ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেন। দেখা যায়, উচ্চ মাত্রায় ৬–৭ দিনে, মধ্য মাত্রায় ১০–১১ দিনে, এবং নিম্ন মাত্রায় ১২ দিনে তারা মাছের মৃত্যু ঘটে। স্বাভাবিক দলে কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। কক-এর উপপাদ্য অনুযায়ী, Vibrio pectenicida FHCF-3-এর রোগ ঘটানোর সম্ভাবনা নিশ্চিত। কক বলছেন, এই পরীক্ষাগুলোতে যদি জীবাণু সব সময় পাওয়া যায়, সেই জীবাণুদের যদি ল্যাবে বড় করা যায়, এবং তা দিয়ে যদি সুস্থ প্রাণী আবার অসুস্থ হয়, আর শেষে সেই জীবাণুই আবার পাওয়া যায় – তাহলে সেই জীবাণুই হলো রোগের মূল কারণ।

এখন প্রশ্ন, এটি কেবল সূর্যমুখী সি স্টারেই সংক্রমণ ঘটায় নাকি অন্যান্য প্রজাতিতেও? ভবিষ্যৎ গবেষণা এ প্রশ্নের উত্তর দেবে। এদিকে ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া ও ওরেগন উপকূলে নতুন প্রজন্মের তারামাছ দেখা গেছে, ২০১৩ সালের পর এই প্রথম। তার মানে প্রাকৃতিকভাবে পুনর্জন্মের সম্ভাবনা এখনও নিঃশেষ হয়নি।

সূত্র : Vibrio pectenicida strain FHCF-3 is a causative agent of sea star wasting disease
Melanie B. Prentice,et.al ; Nature Ecology and Evolution (4th August 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + 8 =