নীলগিরি ঘাসভূমিতে পাখিদের প্রত্যাবর্তন

নীলগিরি ঘাসভূমিতে পাখিদের প্রত্যাবর্তন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩১ আগষ্ট, ২০২৫

অতীতের নথি আর বর্তমানের উপগ্রহ ছবিকে পাশাপাশি বসিয়ে, গবেষকরা নীলগিরির শোলা-ঘাসভূমি বাস্তুতন্ত্রের দীর্ঘকালীন ইতিহাসকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করছেন। লন্ডনের এক গ্রন্থাগারের ১৭৭ বছরের পুরনো ভারতীয় মানচিত্র মেঝেতে জোড়া লাগানোর কাজ থেকে শুরু করে, শতবর্ষ প্রাচীন পাখির নমুনা খুঁজে বের করা- সব মিলিয়ে উঠে এসেছে এক অস্বস্তিকর গল্প। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি কীভাবে নীলগিরির ঘাসভূমি আর সেখানকার পাখিদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দিল। দক্ষিণ ভারতের পশ্চিমঘাটের উঁচু মালভূমি নীলগিরি পাহাড়। হাজার বছরের পুরনো এক অনন্য বাস্তুতন্ত্র – শোলা অরণ্য আর ঢেউ খেলানো ঘাসভূমির মেঝে। প্রায় ২০,০০০ বছরের পুরনো এই শোলা-ঘাসভূমি জীববৈচিত্র্য রক্ষা, নদীর জলের উৎস সংরক্ষণ, এমনকি স্থানীয় কৃষ্টিকে ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য ছিল। কিন্তু মাত্র দুই শতকে ছবিটা বদলে যায়। বিশাল ঘাসের বিস্তার আজ চা, ইউক্যালিপটাস, পাইনের মতো বহিরাগত উদ্ভিদে আচ্ছন্ন। উপগ্রহ বিশ্লেষণ বলছে, মাত্র ৪০ বছরে পশ্চিমঘাটের পাহাড়ি ঘাসভূমির দুই-তৃতীয়াংশ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। নতুন গবেষণা আরও গভীরে গিয়ে দেখাচ্ছে, ১৮৪৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নীলগিরির প্রায় ৮০% ঘাসভূমি হারিয়ে গেছে। আর ৯০% ঘাসভূমি-নির্ভর পাখির সংখ্যা কমে গেছে। গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্নেল ল্যাব অব অর্নিথোলজির পোস্টডক্টরাল ফেলো বিজয় রমেশ। ২০১৬ সাল থেকে নীলগিরিতে কাজ করতে গিয়ে তিনি হাতে পান ১৮৪৮ সালে ক্যাপ্টেন জন অকটারলোনির তৈরি প্রথম পদ্ধতিগত মানচিত্র। এই মানচিত্রের টুকরো ছড়িয়ে ছিল তামিলনাড়ু মহাফেজখানা আর ব্রিটিশ গ্রন্থাগারে। ১০×৬ ফুট আয়তনের সেই মানচিত্র মেঝেতে বিছিয়ে গবেষকরা ছবি তোলেন- যেন এক বিশাল ধাঁধা-চিত্রর টুকরোগুলোকে খাপে খাপে মেলানো। মানচিত্রে চিহ্নিত জমির ধরন হাতে ট্রেস করে ডিজিটাল মানচিত্র বানানো হল দেড় বছরের শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়ায়। তারপর স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তুলনা করে তথ্য যাচাই করা হল। ফলাফল ভয়াবহ। ১৮৪৮-এ যেখানে প্রায় ১,০০০ বর্গকিমি ঘাসভূমি ছিল, ২০১৮-তে তার মাত্র ২০০ বর্গকিমি বেঁচে আছে। মধ্যবর্তী মানচিত্রগুলি থেকে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষতি ঘটেছে ব্রিটিশ আমলে আর স্বাধীনতার পরে সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে। ঔপনিবেশিক শাসকরা স্থানীয় আদিবাসীদের ঘাসভূমি ধ্বংসের দায়ে দোষারোপ করেছিল। তারা এই খোলা জমিকে ‘পতিত’ আখ্যা দিয়ে চা, ওয়াটল, ইউক্যালিপটাসসহ ৪০টিরও বেশি বিদেশি গাছ লাগায়। এই বৃক্ষরোপণ তখন ছিল অর্থনৈতিক সম্পদ, কিন্তু এর ফলে প্রাচীন ঘাসভূমি কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আজও সেই বহিরাগত প্রজাতিগুলো বেঁচে আছে আর সবুজের মোড়কে ঢেকে রেখেছে এক গভীর পরিবেশগত ক্ষতকে। মানচিত্র বিশ্লেষণের পাশাপাশি গবেষক দল খুঁজে দেখেছেন সংগ্রহশালায় রাখা শতবর্ষ পুরনো পাখির নমুনা। ব্রিটেনের ট্রিং-এর ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন সংগ্রহশালা- সব জায়গায় খুঁজে পাওয়া গেছে নীলগিরির পাখির রেকর্ড। ১৮৫০ থেকে ১৯৫০ সাল। এই সময়কার, ৪২টি স্থানের ৮৫টি প্রজাতির উপস্থিতি নথিভুক্ত করা হয়। ২০২১ সালে গবেষকরা আবার সেই স্থানগুলিতে ফিরে গিয়ে সমসাময়িক সমীক্ষা চালান। দেখা যায়, যেসব জায়গায় ঘাসভূমি অটুট, সেখানে এখনও কিছু প্রজাতি টিকে আছে। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গা এখন চা বাগান বা শহরে রূপান্তরিত। নীলগিরি পিপিট আর মালাবার লার্কের মতো বিশেষ ঘাসভূমি প্রজাতি সবচেয়ে বেশি কমে গেছে। মুকুর্থি ন্যাশনাল পার্কই এখন তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। অন্যদিকে, সাধারণত অভিযোজনক্ষম প্রজাতি যেমন পাইড বুশচ্যাট, চা বাগান-এও টিকে গেছে। বনের পাখিদের মধ্যে কারও কারও সংখ্যা স্থিতিশীল। কেউবা সংখ্যায় বেড়েছে। কারণ তারা চা বাগানকে, আংশিক বন হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে গবেষকরা সতর্ক করেছেন, এগুলো কোনোভাবেই প্রকৃত শোলা-অরণ্যের বিকল্প নয়। ঐতিহাসিক জলবায়ুর তথ্য মেলাতে গিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, নীলগিরির গড় তাপমাত্রা গত ১৫০ বছরে প্রায় ১ ডিগ্রি বেড়েছে। এই পরিবর্তনও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। এ গবেষণার অন্যতম শিক্ষা হলো সংগ্রহশালার গুরুত্ব। পুরনো মানচিত্র, পাখির নমুনা, প্রকৃতিবিদদের ডায়েরি, সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে নীলগিরির দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ইতিহাস। ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস-এর আর্কাইভ বিশেষজ্ঞ ভেঙ্কট শ্রীনিবাসন বলেন, “ডিজিটাল প্রাপ্যতা মানেই সংরক্ষণ নয়। দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার জন্য উচ্চমানের মহাফেজ কপি, মেটাডেটা আর নির্ভরযোগ্য পঞ্জি অপরিহার্য। সংরক্ষণ নীতিতে ঘাসভূমি প্রায়শই উপেক্ষিত। এগুলোকে গাছ লাগানোর খালি জমি হিসেবে দেখা হয়। অথচ বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, ঘাসভূমি জীববৈচিত্র্য, কার্বন মজুত, আর জলবাহী ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। দক্ষিণ আফ্রিকা বা মাদাগাস্কারের মতো অন্যান্য প্রাক্তন উপনিবেশেও একই সমস্যা দেখা যায়। নীলগিরিভিত্তিক সংস্থা আপস্ট্রিম ইকোলজির প্রতিষ্ঠাতা বসন্ত বসকো বলেন, “আমরা একটি চা-বাগানের ভেতরে ছোট্ট এক ঘাসভূমি পুনর্গঠন করেছিলাম। সেখানে আবার দেখা দিয়েছে নীলগিরি পিপিট। এই দৃশ্য প্রমাণ করে, পুনর্গঠন সম্ভব।” গবেষণার মূল বার্তা স্পষ্ট: নীলগিরির ঘাসভূমি কেবল এক হারানো অতীত নয়, বরং বর্তমান আর ভবিষ্যতের পরিবেশ নীতিতে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। সংগ্রহ আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে আমরা শুধু অতীতের ধ্বংসের গল্প নয়, বরং টেকসই পুনর্গঠনের সম্ভাবনাও দেখতে পাই।

সূত্র : Grassland Bird Species Decline With Colonial-Era Landscape Change in a Tropical Montane Ecosystem by Vijay Ramesh, et.al ; Global Change Biology (Volume 31,Issue 7) (23 July, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − eight =