শরীর: চলমান পারিবারিক ইতিহাস

শরীর: চলমান পারিবারিক ইতিহাস

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ আগষ্ট, ২০২৫

প্রায় চব্বিশ বছর আগে মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডায়ানা বিআঁকি এক নারীর থাইরয়েড কোষকলা মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করছিলেন। সেই নারী জিনগতভাবে XX ক্রোমোজোমধারী, অর্থাৎ একজন সম্পূর্ণ নারী। কিন্তু লেন্সের নীচে বিআঁকি যা দেখলেন তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল অসংখ্য Y ক্রোমোজোমের ঝিলিক, যা সাধারণত কেবল পুরুষের মধ্যেই পাওয়া যায়। বিস্ময়ে তিনি বলেছিলেন, “তার থাইরয়েডের একাংশ যেন পুরোপুরি পুরুষ হয়ে গেছে।”
কিন্তু এমন ঘটনা কীভাবে সম্ভব? বিআঁকি অনুমান করলেন, এর উৎস গর্ভাবস্থা। ঐ নারী একসময় একটি পুরুষ ভ্রূণ বহন করেছিলেন। গর্ভের ভিতর থেকে সেই ভ্রূণের কিছু কোষ মায়ের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। আশ্চর্যের বিষয়, এই কোষগুলো সেখানে কেবল টিকেই থাকেনি, বরং আশপাশের মাতৃকোষের মতো কাজ শুরু করে দেয়। যেন তারা শরীরেরই অংশ হয়ে ওঠে। বিআঁকির ভাষায়, “মায়ের থাইরয়েড যেন ছেলের কোষের মতন নতুনভাবে সাজানো হয়েছিল।” এই নারীর ঘটনা আলাদা নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি গর্ভধারণেই ভ্রূণের কোষ মায়ের শরীরে প্রবেশ করে। সাধারণত গর্ভাবস্থার চার থেকে পাঁচ সপ্তাহের মাথায় এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পর সেই কোষ ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, স্তন, কোলন, কিডনি, লিভার এমনকি মস্তিষ্কেও। একবার প্রবেশ করলে এই কোষ বছরের পর বছর থেকে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সারা জীবন শরীরের ভেতরে থেকে যায়, বিভাজিত হয়, সংখ্যায় বাড়ে এবং আশপাশের কোষের সঙ্গে মিশে যায়। এই কোষ স্থানান্তরকে বিজ্ঞানীরা বলেন মাইক্রোকাইমেরিজম। এ যেন প্রকৃতির এক প্রাচীন অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া। সিয়াটলের ফ্রেড হাচিনসন ক্যানসার সেন্টারের গবেষক জে. লি নেলসন মন্তব্য করেছেন, “একে ভাবা যায় বিবর্তনের মূল ‘প্রকৃত প্রতিস্থাপন’ হিসেবে।” তবে, কোষের এই যাত্রা একমুখী নয়। ভ্রূণের কিছু কোষ যেমন মায়ের শরীরে প্রবেশ করে, তেমনই মায়েরও কিছু কোষ ভ্রূণের শরীরে চলে যায়। অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর আর সন্তানের শরীর একে অপরের সঙ্গে কোষ বিনিময় করে। সেই কোষগুলি অনেক সময় ভ্রূণের শরীরে প্রাপ্তবয়স পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।
ফলে এক ব্যক্তি শুধু নিজের নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কোষও শরীরে বহন করতে পারেন। ধরুন, মায়ের শরীরে যদি তার বড় সন্তানদের কোষ থেকে যায়, তবে ছোট সন্তানের শরীরেও সেই বড় ভাই-বোনদের কোষ ঢুকে যেতে পারে। আবার মায়ের মা মানে দিদার শরীরের কিছু কোষ মেয়ের মাধ্যমে নাতির শরীরে পৌঁছে যেতে পারে। লন্ডনের রয়্যাল হলোওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তন-জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকো উবেদা দে টোরেস তাই বলেন, “ যেন মনে হয় আমরা আমাদের পুরো পরিবারটাকেই শরীরের ভেতরে বয়ে বেড়াই।” “মাইক্রোকাইমেরিজম” নামটি এসেছে গ্রিক পুরাণের “কাইমেরা” থেকে, যা ছাগল আর ড্রাগনের সমন্বয়ে তৈরি এক অদ্ভুত সিংহের মতো জীব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই কোষ স্থানান্তর গর্ভধারণের চেয়েও সাধারণ একটি ঘটনা। যে কেউ ভ্রূণ বহন করেছেন, যত স্বল্প সময়ের জন্যই হোক না কেন, অথবা যে কেউ গর্ভে থেকেছেন, তাদের শরীরে এই মিশ্র কোষ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন ইঁদুর, গরু, কুকুর এমনকি আমাদের নিকট আত্মীয় বানরদের শরীরেও এই কোষ বিনিময় দেখা গেছে।
তবে সব শরীরে এই কোষ সমানভাবে ছড়ায় না। কোথাও তারা বেশি থাকে, কোথাও কম। অনেক সময় এদের ঘনত্ব খুবই কম – প্রতি দশ লক্ষ কোষে মাত্র একটি। যা পরীক্ষাগারে শনাক্ত করাই কঠিন হয়ে পড়ে। সিনসিনাটি চিলড্রেনস হসপিটালের শিশু-রোগ বিশেষজ্ঞ ও ইমিউনোলজিস্ট সিং সিং ওয়ে বলেন, “এই ঘনত্ব এতটাই কম যে অনেক জৈবিক পরীক্ষার পক্ষে এটি কোনোক্রমে শনাক্ত করা যায় ।” আজ মাইক্রোকাইমেরিজম বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এই কোষ কি মায়ের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে? নাকি তারা কখনও কখনও অটোইমিউন রোগ বা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়? উত্তর এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আমাদের শরীর কেবল আমাদের নয়। এর ভেতর লুকিয়ে আছে আমাদের সন্তানের, ভাই-বোনের, এমনকি পূর্ববর্তী প্রজন্মের কোষের অদৃশ্য উপস্থিতি। শরীর তাই শুধু ব্যক্তিগত নয়, এ যেন জিনগতভাবে গড়ে ওঠা এক চলমান পারিবারিক ইতিহাস।

সূত্র : Reproductive outcomes after pregnancy-induced displacement of preexisting microchimeric cells by Tzu-yu-Shao, et.al ; Science(Vol 381) (21 September, 2023)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 3 =