সোনা কী করে তৈরি হলো

সোনা কী করে তৈরি হলো

অমিতাভ দত্ত
প্রফেসর, স্কুলল অব ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্‌স অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া
Posted on ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সৃষ্টির আদিতে, মানে বিগ ব্যাং যখন ঘটে, তখন দুটো মাত্র মৌলিক পদার্থ ছিল: হাইড্রোজেন বেশি, আর হিলিয়াম সামান্য। আমরা আর যে সব মৌল দেখি, সবই তৈরী করে নক্ষত্রেরা। প্রথমত দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু জুড়ে একটা হিলিয়াম পরমাণু তৈরী হয়, এবং হিলিয়াম পরমাণুর ভর যেহেতু দুটো হাইড্রোজেনের থেকে একটু কম, সেই ভর আইনস্টাইনের E=mc^2 সূত্র অনুযায়ী শক্তিতে পরিণত হয়। এই শক্তিই নক্ষত্রদের শক্তি জোগায়। আমাদের সূর্যের শক্তি তো বেশির ভাগটাই এইভাবে আসে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আরো মৌল তৈরী হতে পারে, যেমন দুটো হিলিয়াম্ জুড়ে একটা কার্বন। কিন্তু এর জন্যে যে তাপ ও চাপের প্রয়োজন তা অনেক বেশি এবং যা শক্তি পাওয়া যায় তা অপেক্ষাকৃত কম। এ বিষয়ে অনেক কিছু লেখা যায়, কিন্তু আজকের আলোচনার বিষয় তা নয়। এইটুকু বলে রাখা ভালো যে পর্যায়সারণিতে লোহার থেকে উঁচু ঘরের মৌল কোনো নক্ষত্রের মধ্যে তৈরী হয় না; কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সেকথা পরে লিখছি।

যেকোনো মৌলের পরমাণুতে নিউক্লিয়াস থাকে একেবারে মধ্যে একটা ছোট্ট জায়গায়, আর তার চারিদিকে থাকে ইলেকট্রনরা। নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন। নিউক্লিয়াসে কটা প্রোটন আছে, সেই সংখ্যাটাই নির্ণয় করে সেটা কোন মৌল। যেমন হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসে একটা প্রোটন, সুতরাং এর মৌলিক সংখ্যা (বা পারমাণবিক সংখ্যা) ১। হিলিয়ামে দুটো প্রোটন, সুতরাং এর মৌলিক সংখ্যা ২। আর প্রোটন ও নিউট্রন মিলিয়ে মোট সংখ্যাটাকে ভর সংখ্যা বলে। হাইড্রোজেনে কোনো নিউট্রন নেই, তাই তার ভর সংখ্যা ১। হিলিয়ামে দুটো নিউট্রন, তাই এর ভর সংখ্যা ৪। লোহার মৌলিক সংখ্যা ২৬, আর সোনার ৭৯, অনেক বেশি। প্রশ্ন হলো সোনা তাহলে তৈরী হয় কী করে?

সেটা বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমে আর একটা ব্যাপার বুঝতে হবে। ইলেকট্রন আর প্রোটনের চার্জ থাকে, ইলেকট্রনের -১, আর প্রোটনের +১। সাধারণত যেকোনো পরমাণুতে সমান সংখ্যক প্রোটন ও ইলেকট্রন থাকে বলে পরমাণুর কোনো চার্জ থাকে না। নিউট্রনের কোনো চার্জ থাকে না। কিন্তু অনেকসময় নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিশেষ ভারসাম্যের অভাব হলে একটা নিউট্রন একটা প্রোটন আর একটা ইলেকট্রনে ভেঙে যায়, আর ইলেকট্রনটা নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে যায় – একে বলে বিটা ডিকে বা অবক্ষয় (beta decay)। এর ফলে নিউক্লিয়াসের প্রোটনের সংখ্যা এক বেড়ে যায়। যেমন লোহার নিউক্লিয়াস থেকে যদি এরকম বিটা ডিকে হয়, তাহলে প্রোটনের সংখ্যা ২৬ থেকে বেড়ে ২৭ হবে, আর তখন লোহার পরমাণুটা নিকেলের পরমাণু হয়ে যাবে। ম্যাজিকের মতো শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু এটা সত্যি ঘটনা, বৈজ্ঞানিকেরা এরকম করেও দেখেছেন।

অর্থাৎ কিনা, একটা লোহার নিউক্লিয়াসে যদি ঠেসে অনেক নিউট্রন ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, আর তাদের যদি বিটা ডিকে হয়, তাহলে লোহার ২৬টা প্রোটনের জায়গায় ৭৯ টা প্রোটন করে দিলেই লোহার পরমাণু সোনার পরমাণু হয়ে যাবে। কিন্তু মুশকিল হলো নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন ঢোকাতে হলে ভয়ঙ্কর রকমের শক্তির প্রয়োজন। নক্ষত্রদের যে অত তাপ আর চাপ, তারাও সে-শক্তির জোগান দিতে পারে না। তাহলে কে পারে?

এক ধরণের নক্ষত্র আছে, যারা শুধু নিউট্রন দিয়ে তৈরী, তাদের বলে নিউট্রন স্টার। দুটো নিউট্রন স্টারের মধ্যে যখন সংঘর্ষ হয়, তখন প্রচণ্ড শক্তিতে নিউট্রনের স্রোত বেরিয়ে আসে, আর আশেপাশে যেসব পরমাণু থাকে তাদের নিউক্লিয়াসে অনেক নিউট্রন ঢুকে যায়। কিন্তু এইসব নিউট্রনকে খুব তাড়াতাড়ি নিউক্লিয়াসে ঢুকতে হবে, কারণ একটু দেরি হলেই যে-নিউট্রন আগে ঢুকেছে তার বিটা ডিকে হয়ে নিউক্লিয়াসটা স্থিতিশীল হয়ে যাবে, তখন আরো নিউট্রন ঢোকা শক্ত। দুটো নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষে এত নিউট্রন বেরোয়, আর এত শক্তিতে, যে অনেক অনেক নিউক্লিয়াসে একসঙ্গে অনেক নিউট্রন খুব তাড়াতাড়ি ঢুকে যায়। পরে তাদের বিটা ডিকে হয়ে সোনার পরমাণু তৈরী হয়। একে বলে ‘আর প্রোসেস’ (r-process , rapid neutron capture process).

গল্প বলে মনে হচ্ছে? তা নয়, প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞানে কোনো কিছু মেনে নিই না আমরা। এই সেদিন ২০১৭ সালে বিজ্ঞানীরা দুটো নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ দেখেছেন, আর সেই সংঘর্ষের আলোয় প্রচুর সোনার প্রমাণ পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা আরো সন্দেহ করেন যে সুপারনোভা বিস্ফোরণ হলে, যখন একটা গোটা নক্ষত্র ফেটে যায়, তখনো সোনা তৈরী হয় এইভাবে। ও হ্যাঁ, কিছু নক্ষত্রের ভেতরেও এইভাবে সোনা তৈরী হয় বটে, কিন্তু তার পরিমাণ খুব কম। তাকে বলে ‘এস প্রোসেস’ (s-process : slow neutron capture process).

তাহলে সমস্যার সমাধান হলো তো? বিজ্ঞানীরাও কিছুদিন খুব খুশি ছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানের মজা হলো, খুশি বেশিদিন থাকা যায় না, নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। দুটো নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষে বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে এক ধরণের আলো বেরোয় যাকে বলে গামা রশ্মি, যা মহাবিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী আলো। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন তাহলে মোট সোনার পরিমাণ কত? পৃথিবীতে অল্প, কিন্তু সব নক্ষত্রের মধ্যেই কিছু সোনা থাকে। নক্ষত্র তৈরী হওয়ার সময় আগের প্রজন্মের নক্ষত্রদের তৈরী সোনা নতুন নক্ষত্রের মধ্যে ঢোকে। আর মহাবিশ্বে কত যে নক্ষত্র আছে, আমাদের ছায়াপথেই আছে ৩০০ কোটি। তাহলে এত সোনা তৈরীর একটা হিসেব করা যাক। এখন টেলিস্কোপ দিয়ে আমরা প্রায় সৃষ্টির শুরু পর্যন্ত দেখতে পাই, আর অনেক দূরের কোনো ঘটনা যা অনেক আগে ঘটেছে তাও দেখতে পাই। কিন্তু দেখা গেল আমরা মাত্র কয়েক হাজার গামা রে দেখেছি, তা এত সোনা তৈরী হবার জন্যে খুবই কম। বিপদের ওপর বিপদ, বিজ্ঞানীরা আরো দেখেছেন যে কিছু সুপারনোভা বিস্ফোরণে গামা রশ্মি বেরোয় বটে, কিন্তু সোনা তৈরী হয় না।

তার মানে সোনা তৈরীর রহস্য আমরা কিছুটা বুঝলেও, পুরোটা এখনো বুঝতে পারি নি। তাও, কোথাও সোনা দেখলে এরকম ভাবা চলে যে কয়েকশো কোটি বছর আগে দুটো নিউট্রন স্টার সেই সোনা তৈরী করেছিল! রোমাঞ্চকর ব্যাপার না ?

One thought on “সোনা কী করে তৈরি হলো

  1. Arindam

    এত কঠিন বিজ্ঞান বিষয় , বাংলায় এরকম প্রান্জল করে বোঝানো খুব সহজ কাজ নয় !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × five =