প্রোটিন ছাড়া জীবন অচল। কোষ মেরামত থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ- প্রায় প্রতিটি প্রক্রিয়ায় প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, জটিল কোষীয় যন্ত্রপাতি তৈরি হওয়ার আগে প্রথম প্রোটিন কীভাবে গঠিত হয়েছিল? ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের রসায়নবিদ অধ্যাপক ম্যাথিউ পাওনার নেতৃত্বে নতুন এক গবেষণা এই ধাঁধার দিকে আলোকপাত করেছে। তাঁরা এমন এক সহজ ও জলবান্ধব রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রদর্শন করেছেন, যা হয়তো প্রোটিন গঠনের পথে প্রথম ধাপ । আর এন এ জিনের তথ্য বহন ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম । তাঁরা দেখিয়েছেন, বিশেষ অবস্থায় আর এন এ অণু অ্যামিনো অ্যাসিডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোই তো প্রোটিনের মূল গঠন-কাঠামো। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ প্রক্রিয়া সহজেই ঘটে জলের মধ্যে, কোনো উৎসেচক ছাড়াই। এর মূল চালিকাশক্তি সালফার যৌগ থেকে তৈরি ‘থিওএস্টার’। আধুনিক কোষে থিওএস্টার নানা বিপাকীয় বিক্রিয়ার জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। প্রাচীন যুগে এগুলো জলে টেকসইভাবে প্রতিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম ছিল, ফলে প্রোটিন সংশ্লিষ্ট রসায়নকে এগিয়ে নিতে পারত। গবেষকরা অ্যামিনো অ্যাসিডের একধরনের সক্রিয় শক্তিধারী রূপান্তর ঘটিয়ে আর এন এ-র নির্দিষ্ট প্রান্তে যুক্ত করতে সক্ষম হন। আশ্চর্যের বিষয়, এই বিক্রিয়া আর এন এর প্রান্তেই বেশি ঘটে। ফলে, এলোমেলো রাসায়নিক ক্রিয়া এড়িয়ে তথ্যের সুশৃঙ্খল সংরক্ষণ সম্ভব হয়। পরীক্ষায় আর্জিনিন অ্যামিনো অ্যাসিড ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকরভাবে যুক্ত হতে দেখা গেছে। এই সাফল্য পূর্ববর্তী গবেষণার সঙ্গেও মিলে যায়। সেখানে দেখা গিয়েছিল, সহ উৎসেচক ‘এ’ -র সক্রিয় অংশ প্যানথেথাইন জলে প্রাণ সৃষ্টির পূর্ব অবস্থায় তৈরি হতে পারে। এবার নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে, সেই শক্তি-সমৃদ্ধ সালফার, আর এন এ-র মাধ্যমে অ্যামিনো অ্যাসিড পরিচালনায় যুক্ত হতে পারে। দুধাপের প্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমে থিওএস্টার অ্যামিনো অ্যাসিডকে আর এন এ -তে যুক্ত করে অ্যামিনোঅ্যাসিল আর এন এ তৈরি করে। এরপর মৃদু অক্সিডেন্ট যোগ করলে পেপটাইড বন্ধন তৈরি হয়। তখন গঠিত হয় পেপটাইডিল আর এন এ। এটি আসলে ছোট ছোট অ্যামিনো অ্যাসিডের শৃঙ্খল, যা প্রোটিন তৈরির দিকে অগ্রগতির অপরিহার্য ধাপ। রসায়নবিদ ড. জ্যোতি সিংহ বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, থিওএস্টারই এখানে সক্রিয় অ্যামিনো অ্যাসিডের রূপ । এ সেই একই ধরনের অণু যা আজকের প্রতিটি জীবিত কোষে সহ উৎসেচক থেকে গঠিত হয়। এটি বিপাক ক্রিয়া, জেনেটিক কোড এবং প্রোটিন গঠনের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটাতে পারে।” প্রসঙ্গত, এই রসায়ন অম্ল-ক্ষার নিরপেক্ষ জলে কার্যকর। এটা প্রাচীন পৃথিবীর হ্রদ, অগভীর জলাশয় বা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছোট জলাশয়ে ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এবং খনিজ পদার্থ থাকায় অণুগুলো সুশৃঙ্খলভাবে সেজে উঠতে পারত। গবেষকরা আরও দেখেছেন, হিমায়িত পরিবেশে এই প্রতিক্রিয়া আরও দ্রুত ঘটে। অধ্যাপক পাওনার মতে, ” খুব smvb প্রাচীন পৃথিবীতে এমন প্রতিক্রিয়াই ঘটছিল।” আধুনিক কোষে প্রোটিন তৈরি হয় রাইবোসোম নামক জটিল যন্ত্রের মাধ্যমে। কিন্তু এই আবিষ্কার প্রমাণ করে, প্রোটিন ছাড়াই RNA অ্যামিনো অ্যাসিড সামলাতে পারত, ফলে জীবনের উৎপত্তির সেই পুরনো “মুরগি না ডিম” সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেখা দিচ্ছে। গবেষকরা মনে করছেন, RNA-অ্যামিনো অ্যাসিডের এই প্রান্তভিত্তিক সংযোগই ভবিষ্যতের জেনেটিক কোডের দিকে সোপান হতে পারে। নির্দিষ্ট RNA সিকোয়েন্সের সঙ্গে নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিডের জোড় তৈরি হলে ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ রাইবোসোম এবং আধুনিক প্রোটিন কোডের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছিল।
সূত্র : Thioester-mediated RNA aminoacylation and peptidyl-RNA synthesis in water by Jyoti Singh,
et.al ; Nature (27 August, 2025) .