মহাকাশের প্রজাপতি নীহারিকা

মহাকাশের প্রজাপতি নীহারিকা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর জন্মকাহিনি বোঝার জন্য আমাদের দৃষ্টি প্রায়ই সমুদ্র, আগ্নেয়গিরি বা প্রাচীন শিলাস্তরের দিকে চলে যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে আকাশগঙ্গার এক অদ্ভুত মহাজাগতিক প্রজাপতির অভ্যন্তরে। যার নাম, ‘বাটারফ্লাই নীহারিকা’। পৃথিবী থেকে প্রায় ৩,৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই নীহারিকা আসলে মৃতপ্রায় নক্ষত্রের ফেলে দেওয়া গ্যাস ও ধূলির জটিল ডানা-সদৃশ বিস্তার। হাবল টেলিস্কোপের ছবি দিয়ে এর আকৃতি আমরা আগেই দেখেছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ-এর মাধ্যমে গবেষকরা নীহারিকার অভ্যন্তরে নজিরবিহীন স্পষ্টতা পেলেন। যা তাঁরা আবিষ্কার করলেন, তা হলো মহাজাগতিক ধূলিকণার দুটি পৃথক রূপ। শান্ত পরিবেশে গড়ে ওঠা স্ফটিকের মতো রত্নখণ্ড এবং অশান্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ছাইয়ের মতো অগোছালো কণা। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. মিকাকো মাতসুওরা বলেন, “একই জ্যোতিষ্কে আমরা এই দুই ধরনের ধূলির উপস্থিতি দেখেছি। এটি গ্রহ গঠনের মূল উপাদান নিয়ে আমাদের বোঝাপড়ায় এক বড় অগ্রগতি।” মহাজাগতিক ধূলো কেবল ধোঁয়ার মতো অগোছালো কণাই নয়- কখনও কখনও তা সিলিকা জাতীয় স্ফটিক আকারেও গঠিত । বাটারফ্লাই নীহারিকায় দু’ধরনের ধূলো পাশাপাশি বিদ্যমান। এটি ইঙ্গিত দেয়, ভিন্ন ভিন্ন মহাকাশীয় পরিবেশ একসঙ্গে একাধিক প্রকারের কণা তৈরি করতে পারে। নীহারিকার কেন্দ্রে রয়েছে প্রায় ২,২০,০০০ কেলভিন তাপমাত্রায় (৩,৯৫,০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) জ্বলতে থাকা এক উত্তপ্ত নক্ষত্র। তবে সেটি দৃশ্যমান আলোয় আড়াল হয়ে আছে গ্যাস-ধূলির ঘন বলয় বা টরাসের মধ্যে। সাধারণ টেলিস্কোপে তাই নক্ষত্রটিকে সরাসরি দেখা যায় না। ওয়েবের মিড-ইনফ্রারেড ইন্সট্রুমেন্ট- এর ক্যামেরা ও স্পেকট্রোগ্রাফ ধূলির ভেতর দিয়ে দেখতে সক্ষম। এর সাহায্যে গবেষকেরা নক্ষত্রকে ঘিরে থাকা উজ্জ্বল ধূলি-মেঘ শনাক্ত করেন। আশ্চর্যজনকভাবে, এই টরাসে থাকা কণাগুলো আকারে খানিকটা বড় – প্রায় এক মাইক্রোমিটার। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, তারা দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। টরাসের বাইরের অঞ্চল অনেক বেশি অস্থির। নীহারিকার আকার দ্বিমেরু বা বাইপোলার। ডানার মতো দুটি অংশ বিপরীত দিকে ছড়িয়ে আছে। কেন্দ্র থেকে ভয়ংকর গতিতে ছুটে আসা জেট প্রবাহের মধ্যে লোহা ও নিকেল চিহ্নিত হয়েছে। গবেষকেরা এর স্তরভিত্তিক খোলস উপাদানও শনাক্ত করেছেন। উচ্চ শক্তি প্রয়োজন এমন মৌলগুলো এগুলোর কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে। আর অপেক্ষাকৃত কম শক্তির মৌল দূরে ছড়িয়ে যায়। এতে বোঝা যায়, নীহারিকার অভ্যন্তর গঠনগতভাবে বেশ সুসংগঠিত, যদিও তার দৃষ্ট রূপ অস্থির ও বিক্ষিপ্ত।

সবচেয়ে বড় চমক আসে পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (PAHs) নামক কার্বনভিত্তিক অণুর সন্ধানে। এগুলো সাধারণত কার্বনসমৃদ্ধ পরিবেশে তৈরি হয়, অথচ বাটারফ্লাই নীহারিকা অক্সিজেনসমৃদ্ধ। এই অণুগুলোর উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, হয়তো দ্রুত গতির নাক্ষত্রিক বাতাস গ্যাসের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে অপ্রচলিত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এটাই হয়তো অক্সিজেনসমৃদ্ধ নীহারিকায় PAHs তৈরি হওয়ার প্রথম প্রমাণ । ‘প্ল্যানেটারি নীহারিকা’ নামটি বিভ্রান্তিকর হলেও এগুলো আসলে সূর্যের মতো মধ্যম আকারের নক্ষত্রের শেষ অধ্যায়। নক্ষত্র তার বাইরের স্তর ঝরিয়ে দিয়ে সাদা বামন নক্ষত্রে রূপ নেয়। এই প্রক্রিয়ায় যে ধূলি ও মৌল তৈরি হয়, সেগুলো পরবর্তীতে নতুন নক্ষত্র ও গ্রহের জন্মের কাঁচামাল হিসেবে কাজ করে। নীহারিকার জীবনকাল মাত্র ২০,০০০ বছরের মতো – মহাজাগতিক সময়ের বিচারে এক নিমেষ! তবুও এই অল্প সময়েই তারা গ্যালাক্সির রাসায়নিক মানচিত্র গড়ে তোলে। ওয়েব টেলিস্কোপের সঙ্গে আটাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে রেডিও পর্যবেক্ষণ যুক্ত করে বিজ্ঞানীরা প্রায় ২০০টি ভিন্ন বর্ণালী রেখা শনাক্ত করেছেন। এগুলো দেখিয়েছে কীভাবে বিভিন্ন মৌল স্তরে স্তরে সাজানো থাকে। এটি নীহারিকার অভ্যন্তরীণ জটিলতাকে নতুনভাবে উন্মোচন করেছে। ড. মাতসুওরা বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশে ধূলি কীভাবে তৈরি হয়, তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের সেই রহস্য উন্মোচনে নতুন আলো জুগিয়েছে।” বাটারফ্লাই নীহারিকার শোভা কেবল বাহ্যিক। এর ভেতরে রয়েছে তারামৃত্যুর কারখানা, যেখানে ধূলি ও অণুর জন্ম হচ্ছে। সেই উপাদান থেকেই ভবিষ্যতের গ্রহ গঠিত হয়। পৃথিবীর মতো শিলাময় জগতের উৎপত্তি বোঝার পথে এ আবিষ্কার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা আমাদের বলে দিচ্ছে, মহাজাগতিক প্রজাপতির ডানার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের কাঁচামাল।

 

সূত্র : “The JWST/MIRI view of the planetary nebula NGC 6302 – I. A UV-irradiated torus and a hot bubble triggering PAH formation” 27 August 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × four =