তপ্ত সমুদ্র ও বিশ্বের কার্বনভাণ্ডার

তপ্ত সমুদ্র ও বিশ্বের কার্বনভাণ্ডার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সমুদ্র আমাদের সবচেয়ে বড় মিত্র। মহাসাগরগুলো প্রতি বছর মানবসৃষ্ট মোট কার্বন ডাই–অক্সাইডের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শোষণ করে নেয় এবং বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা অতিরিক্ত তাপের প্রায় ৯০ শতাংশ ধারণ করে। কিন্তু ২০২৩ সালে, অস্বাভাবিক উষ্ণ সমুদ্র সেই ভারসাম্যকে নাড়া দেয়। ওই বছরে একদিকে শক্তিশালী এল নিনো, অন্যদিকে উত্তর আটলান্টিকের প্রচণ্ড তাপ, সব মিলিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। ই টি এইচ জুরিখের নেতৃত্বে এক আন্তর্জাতিক দল উপগ্রহ তথ্য মিলিয়ে দৈনিক কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমনের মানচিত্র তৈরি করে। ফলাফল ছিল চমকে দেওয়ার মতো: ২০২৩ সালে সমুদ্র প্রায় এক বিলিয়ন টন কম CO₂ শোষণ করেছে। এ পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্ষিক নির্গমনের প্রায় অর্ধেক, সুইজারল্যান্ডের নির্গমনের বিশ গুণ।
এ ঘটনার পেছনে রয়েছে পদার্থবিদ্যার সরল নিয়ম। ঠান্ডা জলে গ্যাস বেশি দ্রবীভূত হয়, গরম জলে কম। ২০২৩ সালে বিশেষ করে উত্তর আটলান্টিক এতটাই উষ্ণ হয়ে উঠেছিল যে সমুদ্র কার্বন শোষণের বদলে বরং বাতাসে কার্বন ছেড়ে দিতে শুরু করে।

তবে সমুদ্র একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি, অর্থাৎ এই আঘাত পুরোপুরি বিধ্বংসী হয়নি। তিনটি প্রক্রিয়া ক্ষতি কিছুটা সামলে নেয়।
১. কিছু কার্বন বেরিয়ে গেলে পৃষ্ঠজলে ঘাটতি তৈরি হয়, যা পরে শোষণের হার বাড়াতে সাহায্য করে।
২. উষ্ণতার কারণে জলের স্তরবিন্যাস শক্তিশালী হয়, ফলে গভীর থেকে কার্বনসমৃদ্ধ জল ওপরে উঠতে পারেনি।
৩. সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে কার্বন ধরে রেখে প্ল্যাঙ্কটন জৈব পদার্থ হিসেবে তাকে গভীরে পাঠাতে থাকে।
এভাবে সৃষ্টি হয় এক টানাপোড়েন। তাপমাত্রা একদিকে কার্বন বের করে দিচ্ছিল, আবার সামুদ্রিক স্তরবিন্যাস ও জীববৈচিত্র্য সেটিকে কিছুটা সামলে নিচ্ছিল।
প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চল সাধারণত এল নিনোর বছরে কম কার্বন ছাড়ে, ২০২৩ সালেও তাই ঘটেছিল। কিন্তু উত্তর আটলান্টিকের প্রচণ্ড উষ্ণতা সেই সুবিধাকে নষ্ট করে দেয়। ফলে দুর্বলতর হয় বৈশ্বিক কার্বন ভান্ডার।
এই গবেষণা কিন্তু অনুমান নয়, নির্ভেজাল বাস্তব পর্যবেক্ষণনির্ভর। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, সমুদ্র ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে, সামুদ্রিক তাপপ্রবাহও বাড়ছে। আজ যেসব প্রতিরোধী প্রক্রিয়া সিস্টেমকে বাঁচাচ্ছে, তা ভবিষ্যতেও টিকবে কি না, বলা যাচ্ছে না।
২০২৩ সালের ঘটনাটি ছিল একধরনের “পীড়ন পরীক্ষা”। সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে যে, সমুদ্র এখনো বৈশ্বিক কার্বন ভাণ্ডার রক্ষায় সবচেয়ে বড় সহযোগী হলেও উষ্ণতা বাড়লে তার ক্ষমতা অনেকটাই কমে যেতে পারে। তাই মূল সমাধান একটাই : কার্বন নির্গমন দ্রুত কমানো। সমুদ্রের উষ্ণতা যতটা রোধ করা যাবে ,ততটাই টিকে থাকবে পৃথিবীর এই বিশাল কার্বনভান্ডার। আর আমাদের গ্রহকে রক্ষার লড়াই ততটাই সহজ হবে।

সূত্র: Unexpected decline in the ocean carbon sink under record-high sea surface temperatures by Jens Daniel Müller, et.al ; Nature Climate Change ; (2nd September, 2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − 10 =