
মানব মস্তিষ্ক এখনো এক রহস্যময় অঙ্গ। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস বা কিডনি প্রভৃতি অঙ্গ সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানলেও মস্তিষ্কের আণবিক স্তর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনো অস্পষ্ট। সেই অজ্ঞতা নিরসনের জন্য গবেষণা চালাচ্ছেন ড. আলেকজান্ডার ডব্লিউ. চার্নি। তাঁর পরিচালিত জীবিত মস্তিস্ক ( লিভিং ব্রেইন ) প্রকল্প স্নায়ুবিজ্ঞানের পুরোনো ধারণাকে বদলে দিয়ে সামনে এনেছে এক নতুন দিশা।
এতদিন গবেষণার জন্য মৃত্যুর পর জমাটবাঁধা মস্তিষ্কের কোষকলা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু চার্নির প্রকল্প প্রথমবারের মতো নিউরোসার্জারির সময় জীবিত রোগীর কোষকলা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করছে। ইতিমধ্যেই ৩০০টির বেশি নমুনা সংগ্রহের পর দেখা গেছে, জীবিত মস্তিষ্কে ৮০% জিন মৃত মস্তিষ্কের তুলনায় ভিন্নভাবে কাজ করে। এই আবিষ্কার দীর্ঘদিনের অসংখ্য গবেষণাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে বিজ্ঞানীদের।
কোভিড-১৯ মহামারি অনেক গবেষককে তাদের কাজ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ডঃ চার্নির জন্য, এটি একটি মোড় ফেরার ঘটনা হয়ে ওঠে।
২০২০ সালের মার্চে যখন নিউইয়র্ক কোভিড-১৯ -এর প্রথম ঢেউয়ের মুখোমুখি হল, তখন তিনি ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তার পুরো ল্যাবটি মোতায়েন করেছিলেন। সেসময় তাঁর দল নেচার মেডিসিন, সেল এবং সায়েন্সে মূল গবেষণা প্রকাশ করেছে। এর পরপরই, তিনি এনআইএইচ রিকভারি ইনিশিয়েটিভের মুখ্য তদন্তকারী হয়েছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি কোভিড চর্চার জন্য ২২ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা হল, সংকটই নতুন আবিষ্কারের গতি বাড়াতে পারে।
চার্নির স্বপ্ন হলো নির্দিষ্টমুখী মেডিসিন—অর্থাৎ প্রত্যেক রোগীর সুনির্দিষ্টি জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত চিকিৎসা। লিভিং ব্রেইন প্রজেক্ট ছাড়াও এজন্য তিনি মাউন্ট সাইনাই মিলিয়ন হেলথ ডিসকভারিস প্রোগ্রামের সহ-নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেখানে এক মিলিয়ন মানুষের জিন তথ্য বিশ্লেষণ করা হবে। এতে শুধু সাধারণ রোগ নয়, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সমস্যাও সামনে আসবে।
তাঁর জীবনের লক্ষ্য একটাই, গুরুতর মানসিক রোগের কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবন। বিশেষ করে স্কিজোফ্রেনিয়া, যা চিন্তা ও আবেগকে ভীষণভাবে ব্যাহত করে। এজন্য তিনি কম্পিউটেশনাল সাইকিয়াট্রি, জিনোমিক্স ও মাল্টি-ওমিক্স বিশ্লেষণের সমন্বয় করছেন। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মস্তিষ্ক সংক্রান্ত বিপুল তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তিনি ব্লাউ অ্যাডোলেসেন্ট কনসালটেশন সেন্টার ও ব্রেইন অ্যান্ড ডেটা সায়েন্সেস ল্যাবও পরিচালনা করেন, যেখানে মানবিক পরিচর্য ও উচ্চপ্রযুক্তি মিলিত হয়েছে।
চার্নি বলেছেন , গবেষকরা অনেক সময় রোগীর কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত খ্যাতিকে অগ্রাধিকার দেন। তাঁর মতে, প্রকৃত বিজ্ঞান হবে নিখুঁত, পুনরায় যাচাইযোগ্য এবং রোগীকেন্দ্রিক।
তিনি এআই-ভিত্তিক রোবট অ্যামিকার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যা ভবিষ্যতের চিকিৎসায় মানব-যন্ত্র সহযোগিতার সম্ভাবনা দেখিয়েছে।
লিভিং ব্রেইন প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা দেখলাম , মানবমস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচন শুধু প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব নয় । এর জন্য দরকার রোগীদের প্রতি দায়বদ্ধতা, সৃজনশীলতা ও সাহসী নেতৃত্ব। চার্নির কাজ প্রমাণ করছে, স্নায়ুবিজ্ঞানকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা শুধু যে সম্ভব তা ই নয়, সেকাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
সূত্র: Leveraging genomics to advance the treatment of mental illness by Alexander W Charney ; Genomic Psychiatry (29th July, 2025).