মানবশিশু ও বানরশিশুর কলকাকলি

মানবশিশু ও বানরশিশুর কলকাকলি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শিশুরা যখন কথা বলার চেষ্টা করে, আর বাবা-মা সেই শব্দের জবাব দেন, তখন সেটি কেবল আদুরে, অস্পষ্ট আড্ডা নয়। বরং এই আদান-প্রদানই শিশুর ভাষা শেখার প্রাথমিক ভিত গড়ে তোলে। প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষ এই শেখার কৌশলের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অল্প কিছু প্রজাতি, যেমন গায়ক পাখিদের মধ্যে কাউবার্ড বা জেব্রা ফিঞ্চ- বাবা মায়ের প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে ডাক শেখে। মানুষ কিভাবে এই অদ্ভুত দক্ষতা অর্জন করল? নতুন এক গবেষণা এই রহস্যের উত্তর খুঁজছে, মানুষের আত্মীয়গোষ্ঠী প্রাইমেটদের মধ্যে। গবেষকরা এবার নজর দিয়েছেন এক ছোট আকারের বানরের দিকে। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ঘন অরণ্যে বসবাসকারী মারমোসেট। প্রায় এক দশক আগে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী আসিফ গাজানফার ও সহকর্মীরা লক্ষ্য করেন, মানবশিশুর মতো মারমোসেট শাবকও জীবনের শুরুতে কথা বলার পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অগোছালো কান্না ধীরে ধীরে শিসের মতো ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক ডাক হয়ে ওঠে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার হল, এই শাবকরা বেশি মাত্রায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়। তারা অনেক দ্রুত প্রাপ্তবয়স্ক-সদৃশ ডাক শিখে ফেলে। ২০১৫ ও ২০১৭ সালে প্রকাশিত এসব ফলাফল প্রমাণ করে, আরেক প্রাইমেটেও কণ্ঠশিক্ষার প্রমাণ মিলতে পারে। কিন্তু মানুষ আর মারমোসেটের শেষ যৌথ পূর্বপুরুষ প্রায় ৪ কোটি বছর আগে বেঁচে ছিল। অথচ আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শিম্পাঞ্জি খুব অল্প প্রশিক্ষণেই তাদের স্বাভাবিক শব্দ উৎপাদন করতে সক্ষম। এ যেন এক জটিল ধাঁধা। এবার গাজানফারের দল নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করল। প্রিন্সটনের পিএইচডি ছাত্রী রেনাটা বিয়াজ্জির নেতৃত্বে দলটি মানুষ, মারমোসেট, শিম্পাঞ্জি এবং রিসাস মাকাক এই চারটি প্রাইমেট-এর ভ্রূণাবস্থা থেকে কৈশোরকাল পর্যন্ত মস্তিষ্কবিকাশের তথ্য একত্রিত করে তুলনা করে। জানা গেল, মানুষের মতো মারমোসেটের মস্তিষ্ক জন্মের পরবর্তী সময়েই সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে। শিম্পাঞ্জি বা মাকাকের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি অনেকটা গর্ভকালীন অবস্থায় সম্পন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ মানুষ ও মারমোসেট দু’জনের জীবনেই বাইরের জগতে প্রবেশের সময়টা একইসঙ্গে সামাজিক ও স্নায়বিক বিকাশের মোক্ষম সময়। মারমোসেটের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, একা মায়ের উপর লালনপালনের ভার থাকে না। পুরো পরিবার মিলে শাবককে যত্ন করে। ফলে প্রতিটি কান্না বা কথার জবাব মেলে বহু দিক থেকে। গাজানফারের ভাষায়, “তাদের সামলানো সত্যিই কঠিন।” কিন্তু এই বহুমাত্রিক সামাজিক প্রতিক্রিয়াই শাবকের শেখার প্রক্রিয়াকে গতিময় করে তোলে। গবেষকরা একটি গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, দ্রুত মস্তিষ্কবৃদ্ধি এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ার যুগল প্রভাব শিশুকে ভবিষ্যতের ভাষিক দক্ষতা লাভের জন্য প্রস্তুত করে। এখন গবেষণা দলটি খতিয়ে দেখতে চাইছে, প্রাপ্তবয়স্ক মারমোসেটরা কি শিশুদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিশেষ কোনো ধরণের শব্দ ব্যবহার করে? যেমন মানুষ শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় ‘আধো আধো কথা ’ বলে। এই গবেষণা কেবল মানুষ ও মারমোসেটের মধ্যে অপ্রত্যাশিত মিলকে সামনে আনছে না, বরং ভাষার বিবর্তন ঘিরে নতুন আলোকপাত করছে। শিশুর কথা থেকে শুরু করে যুক্তিতর্কে অংশগ্রহণ করার সক্ষমতা- এই দীর্ঘ পথচলার সূচনা হয় জীবনের একেবারে প্রথম মাসগুলোতে যখন মস্তিষ্ক থাকে সবচেয়ে নমনীয়। গাজানফার বলেন, “আমরা আসলে কেবল শৈশবকালীন কণ্ঠশিক্ষার কথা বলছি। এই সময়টাই মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল।”

 

সূত্র : Babbling opens the sensory phase for imitative vocal learning by Albertine Leitão , et.al ; Proceedings of the National Academy of Science (19th August, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − 3 =