মানুষের গড় আয়ুবৃদ্ধির হার কমছে

মানুষের গড় আয়ুবৃদ্ধির হার কমছে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মানুষের গড় আয়ু ১৯০০ সালে ছিল মাত্র ৬২ বছর। সেটা ১৯৩৮ সালে দাঁড়ায় প্রায় ৮০ বছরে। চিকিৎসা, টিকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ও শিশুমৃত্যু কমে যাওয়ার মতো অসাধারণ অগ্রগতি এই পরিবর্তনের মুলে কাজ করেছে। বিজ্ঞানীরা একসময় মনে করেছিলেন, এই ধারা যদি বজায় থাকে তবে ১৯৮০ সালে জন্ম নেওয়া মানুষ সহজেই গড়ে ১০০ বছর অবধি বাঁচতে পারবে। কিন্তু সর্বশেষ আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট, ফ্রান্সের আই এন ই ডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা একত্রে পি এন এ এস জার্নালে ২৩টি ধনী দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন , বিংশ শতকের প্রথমার্ধের মতো আর দ্রুত আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

 

তাঁরা ১৯৩৯ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ আয়ুষ্কাল প্রক্ষেপ করেছেন। গবেষণায় ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যথা রাষ্ট্রসংঘের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রস্পেক্টস, লি-কার্টার মডেলসহ সর্বাধুনিক পরিসংখ্যানগত কৌশল।

আশ্চর্যের বিষয়, সব কটি মডেলই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে : ১৯৩৯ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের আয়ু বাড়ছে বটে, কিন্তু আগের তুলনায় অনেক ধীর গতিতে। যেখানে ১৯০০ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে প্রতিটি নতুন প্রজন্মের আয়ু গড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস করে বাড়ছিল, এখন সেই বৃদ্ধি নেমে এসেছে আড়াই থেকে সাড়ে তিন মাসে। গবেষকেরা স্পষ্ট করে বলছেন, ১৯৮০সালে জন্ম নেওয়া মানুষ গড়ে ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচবে না, এমনকি এ সময়ের কোনো প্রজন্মই সেই মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে না।

এর কারণ খুবই সহজ, বিংশ শতকের শুরুর বিস্ময়কর সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি ছিল শিশুমৃত্যুর হার দ্রুত হ্রাস। একসময় হাজারে হাজারে শিশু জন্মের পরই মারা যেত। টিকার প্রচলন, অ্যান্টিবায়োটিক, পরিচ্ছন্ন পানীয় জল ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা সেই মৃত্যুহার কমিয়ে দেয়। ফলে গড় আয়ু দ্রুত বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে শিশুমৃত্যু এতটাই কমে এসেছে যে সেখান থেকে আর কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতির সুযোগ নেই।

এখন লক্ষ্য হচ্ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মৃত্যুহার কমানো। কিন্তু প্রবীণদের আয়ুষ্কাল যতটা ধীরে বাড়ছে, তা দিয়ে আগের যুগের গতিকে আর ধরা সম্ভব নয়। গবেষকেরা হিসাব করে দেখিয়েছেন , যদি প্রবীণদের বেঁচে থাকার হার দ্বিগুণ বাড়ে, তবুও তা বিংশ শতকের প্রথম দিকের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির সমান হবে না।

তবে তাঁরা সতর্কও করেছেন যে এসব প্রক্ষেপণ কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়। হঠাৎ ঘটে যাওয়া মহামারি (যেমন- কোভিড-১৯), যুগান্তকারী চিকিৎসা প্রযুক্তি কিংবা সামাজিক পরিবর্তন সবকিছুই আয়ুষ্কালকে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই এগুলোকে নিশ্চিত সত্য নয়, বরং শিক্ষিত অনুমান হিসেবে দেখা উচিত।

 

এই গবেষণা কেবল সংখ্যার হিসাব বা ব্যক্তিগত কোনো হিসাবও নয়, এর গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। গড় আয়ু যদি প্রত্যাশার তুলনায় ধীরে বাড়ে, তবে সরকারকে স্বাস্থ্যনীতি, অবসরকালীন ভাতা, ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যদিকে, ব্যক্তি পর্যায়ে সঞ্চয়, অবসর পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি জীবনের প্রস্তুতিতেও এর প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ, গড় আয়ু যদি প্রত্যাশার তুলনায় ধীরে বাড়ে, তবে সমাজ ও ব্যক্তিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

 

সূত্র: “Cohort mortality forecasts indicate signs of deceleration in life expectancy gains” by José Andrade, Carlo Giovanni Camarda and Héctor Pifarré i Arolas, (25.09.2025), Proceedings of the National Academy of Sciences.

DOI: 10.1073/pnas.2519179122

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 + 4 =