সর্পাঘাতে মৃত্যুর শীর্ষে ভারত

সর্পাঘাতে মৃত্যুর শীর্ষে ভারত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ভারতে পৃথিবীর মধ্যে সাপের কামড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে। প্রতিবছর হাজারো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, আর এর প্রধান কারণ চারটি মারাত্মক বিষধর সাপ—ইন্ডিয়ান ক্রেইট (বাঙ্গারাস কেরুলিয়াস), রাসেল ভাইপার (ডাবোইয়া রুসেলি ), সো-স্কেল্ড ভাইপার (ইচিস ক্যারিনাটাস ) এবং কোবরা (নাজা নাজা )। এদের একত্রে বলা হয় “বিগ ফোর।” সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী পাঁচ দশকে অনেক জায়গায় এই সাপেরা তাদের পুরনো আবাস হারাবে, এবং ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর এলাকাগুলো দখল করবে। ফলে মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ বাড়বে।

বিজ্ঞানীরা উন্নত স্পিসিস ডিস্ট্রিবিউশান মডেল ব্যবহার করে বর্তমানে বিগ ফোর প্রজাতির বিস্তৃতি নির্ধারণ করেছেন। তারপর ভবিষ্যতের (২০৮০ সাল পর্যন্ত) জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রেক্ষাপটে এদের বিস্তার কেমন হবে, তা অনুমান করেছেন। শুধু তাই নয়, এই মানচিত্রকে কৃষিজমি, শহরাঞ্চল, সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতার সঙ্গে যুক্ত করে একটি ঝুঁকির সূচক তৈরি করা হয়েছে। ফলে কোন কোন জেলা এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে কোন কোন অঞ্চল নতুন করে হুমকির মুখে পড়বে, তা স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে— দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের চিক্কাবল্লাপুরা, হাভেরি, চিত্রদুর্গ এবং গুজরাটের দ্বারকা, জামনগর বর্তমানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল।
আগামী কয়েক দশকে ঝুঁকি আরও বাড়বে উত্তর-পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে আসামের নগাঁও, মরিগাঁও, গোলাঘাট, মণিপুরের তেংনৌপাল, এবং উত্তর ভারতের রাজস্থানের প্রতাপগড় জেলায়। বোঝা গেল দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে অবিলম্বে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৪.৫–৫.৪ মিলিয়ন মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ৮১,০০০ থেকে ১.৩৮ লাখ মানুষ মারা যান। আরও কয়েকগুণ মানুষ চিরস্থায়ী অক্ষমতার শিকার হন, যেমন হাত-পা কেটে ফেলা বা অন্যান্য জটিলতা। অথচ সময়মতো সঠিক অ্যান্টিভেনম পাওয়া গেলে এধরণের মৃত্যুর বড় অংশই এড়ানো সম্ভব। এ কারণে ২০১৭ সালে হু সাপের কামড়কে “অব হেলিত উষ্ণ মন্ডলীয় অসুখ ” হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এবং ২০১৯ সালে ২০৩০ সালের মধ্যে মৃত্যু ও অক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঘোষণা করে।
ভারত ইদানীং এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে। প্রতিবছর এখানে ৪৫,০০০–৫০,০০০ মৃত্যু ঘটে, যা বিশ্বের মোট সর্পাঘাত মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক। ২০০৫ সালের একটি বিশ্লেষণেই দেখা গিয়েছিল, এক বছরে ভারতে প্রায় ৪৬,০০০ মৃত্যু ঘটেছে, যা হু -র আগের বৈশ্বিক অনুমানের সমান। ভারতের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অঞ্চলে, যেখানে সাপেরা ইঁদুর ও ব্যাঙের মতো শিকার খুঁজতে আসে, সেখানে কামড়ের ঘটনা বেশি ঘটে। দেশের প্রায় ৯০% মৃত্যুর জন্য দায়ী এই “বিগ ফোর” প্রজাতি(ক্রেট, রাসেল ভাইপার, সো-স্কেলড ভাইপার ও কোবরা)। তাছাড়া , ভারতে সাপের কামড় সাধারণত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেই বেশি আঘাত করে। যেসব এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা সীমিত, সেখানে বিষপ্রয়োগের চিকিৎসা দেরিতে পাওয়া যায়, আর মৃত্যুর হারও বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নতুন এলাকায় যদি ঝুঁকি বাড়ে, তবে স্থানীয় মানুষ প্রস্তুত না থাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এ সমস্যার সমাধানে শুধু অ্যান্টিভেনম নয়, দরকার বহুমুখী কৌশল: স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো শক্তিশালী করা,ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অ্যান্টিভেনম মজুত রাখা, সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নীতিমালা প্রণয়ন।

সাপের কামড় শুধু একটি স্থানীয় সমস্যাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংকট। এই প্রথম কোনো গবেষণা সুস্পষ্টভাবে দেখাল, আগামী পঞ্চাশ বছরে ভারতের কোন কোন অঞ্চল সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে পড়বে। তাই জাতীয় সরকার, আঞ্চলিক স্বাস্থ্যসংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মহলের একযোগে উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

সূত্র :Future of snakebite risk in India: Consequence of climate change and the shifting habitats of the big four species in next five decades by Imon Abedin, Hey-Eun Kang, et.al ; PLOS Neglected Tropical Disease (Published: September 2, 2025)

One thought on “সর্পাঘাতে মৃত্যুর শীর্ষে ভারত

  1. Sunish Jhumur Deb

    Thank you. Didn’t know the situation was so grave. Sharing in all groups

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 + 11 =