
মানুষ আজ যে প্রাণবন্ত পৃথিবীতে বাস করছে, তা কিন্তু একেবারেই স্বাভাবিক বা নিশ্চিত কোনো ঘটনা নয়। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে পৃথিবীর প্রাথমিক রাসায়নিক গঠন সৌরজগৎ সৃষ্টি হওয়ার মাত্র তিন মিলিয়ন বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে ম্যানগানিজ-৫৩ নামক তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ক্ষয় প্রক্রিয়া। প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন বছরের অর্ধায়ু বিশিষ্ট এই আইসোটোপ সৌরজগতের প্রাথমিক কালে উপস্থিত ছিল এবং ক্ষয়ে গিয়ে ক্রোমিয়াম-৫৩ তে রূপান্তরিত হয়। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে কয়েক বিলিয়ন বছর পুরনো পদার্থের বয়স এক মিলিয়ন বছরেরও কম ত্রুটিসীমায় নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এই নির্ভুল পরিমাপের পেছনে সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বার্ন-এর ভূ-রসায়ন বিভাগের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দক্ষতা ও আধুনিক পরিকাঠামোর ভূমিকা মুখ্য।
প্রথম লেখক ক্রুটাশ জানিয়েছেন, গবেষণা অনুযায়ী সৌরজগতের জন্ম আজ থেকে প্রায় ৪,৫৬৮ মিলিয়ন বছর আগে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, পৃথিবীর রাসায়নিক পরিচয় মাত্র তিন মিলিয়ন বছরের মধ্যেই স্থির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনকার পৃথিবী ছিল একেবারেই শুষ্ক ও প্রাণহীন—শুধু কঠিন পাথর আর ধূলির সমাহার।
তারপরই ঘটে সেই নিয়তির খেলা। পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আরেক গ্রহ থেইয়ার। থেইয়া সম্ভবত সৌরজগতের দূরবর্তী এলাকায় তৈরি হয়েছিল, যেখানে জল ও উদ্বায়ী উপাদান জমে থাকতে পারত। সেই ভয়াবহ সংঘর্ষেই পৃথিবী পায় জল এবং প্রাণের জন্য অপরিহার্য সব উপাদান। আজ আমরা যাকে “নীল গ্রহ” বলে চিনি, তার প্রাণবন্ত হওয়ার আসল কৃতিত্ব এই দুর্ঘটনাজনিত সংঘর্ষের। অর্থাৎ পৃথিবীর জীবন-সম্ভাবনা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ফল ছিল না, বরং এক আকস্মিক মহাজাগতিক ঘটনার উপহার।
সহলেখক এমেরিটাস অধ্যাপক ক্লাউস মেজগার ব্যাখ্যা করেন, এই গবেষণা আমাদের জানায় যে পৃথিবী জীবনের জন্য উপযোগী হয়ে ওঠে কেবল একটি বিরল দুর্ঘটনার কারণে। তাই মহাবিশ্বে সজীব পরিবেশের অস্তিত্ব মোটেও স্বাভাবিক বা নিশ্চিত নয়। বরং পৃথিবীর মতো গ্রহের জন্ম ও জীবনের বিকাশ এক অনন্য সৌভাগ্যের প্রতীক।
ভবিষ্যৎ গবেষণার মূল লক্ষ্য হবে অর্ধগঠিত পৃথিবী ও থেইয়া-র সংঘর্ষকে আরও বিস্তারিতভাবে বোঝা। এখনো সেই ঘটনার পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা অনুপস্থিত। বিজ্ঞানীরা নতুন মডেলের মাধ্যমে শুধু পৃথিবী-চাঁদের ভৌত বৈশিষ্ট্য নয়, তাদের রাসায়নিক ও সমস্থানিক গঠনও ব্যাখ্যা করতে চান।
এ আবিষ্কার শুধু পৃথিবীর জন্মের ইতিহাসই নয়, বরং মহাবিশ্বে জীবনের সম্ভাবনা কতটা বিরল ও অনিশ্চিত ছিল তা দেখায়। জীবন কোনো স্বাভাবিক নিয়ম নয় এ এক মহাজাগতিক আকস্মিকতা।
সূত্র : “Time of proto-Earth reservoir formation and volatile element depletion from 53Mn-53Cr chronometry” by Pascal M. Kruttasch and Klaus Mezger, 1 August 2025, Science Advances.
DOI: 10.1126/sciadv.adw1280