এস -ফিনিক্স: এক সময়-সন্ধানী জানালা

এস -ফিনিক্স: এক সময়-সন্ধানী জানালা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মহাবিশ্বের জন্মের কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড পরে যে অগ্নিগর্ভ স্যুপ-সদৃশ পদার্থটি তৈরি হয়েছিল, তাকে বলা হয় ‘কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমা’ (QGP)। এর রহস্য ভেদ করতে গবেষকরা বহু দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। এবার ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির রিলেটিভিস্টিক হেভি আয়ন কোলাইডার-এ স্থাপিত নতুন প্রজন্মের ডিটেক্টর এস-ফিনিক্স (sPHENIX) প্রমাণ করল যে এটি এই কাজের জন্য প্রস্তুত। এম আই টি-এর পদার্থবিদদের সঙ্গে মিলে এক আন্তর্জাতিক দল জানিয়েছে, সোনার আয়নকে আলোর কাছাকাছি গতিতে সংঘর্ষ করিয়ে যে কণাসমূহ বেরিয়ে এসেছে, তাদের সংখ্যা ও শক্তি এই যন্ত্র নিখুঁতভাবে মেপেছে। পদার্থবিজ্ঞানে এটি “স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল” পরীক্ষা নামে পরিচিত। এ একটি নির্ভরযোগ্য ধ্রুবক মান, যা দিয়ে যন্ত্রের নির্ভুলতা যাচাই করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন দুটি সোনার আয়ন সরাসরি মুখোমুখি সংঘর্ষ করেছে, তখন উৎপন্ন চার্জযুক্ত কণার সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেশি হয়েছে। আর সেই কণাগুলির শক্তিও ছিল ১০ গুণ বেশি। পদার্থবিদ রোল্যান্ড একে তুলনা করেছেন নতুন মহাকাশ দূরবীন উৎক্ষেপণের সঙ্গে। “প্রথম ছবিতে হয়তো নতুন কিছু নেই, কিন্তু সেটাই প্রমাণ করে যন্ত্রটি এখন সত্যিকার গবেষণার জন্য প্রস্তুত।”

কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমা হল কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন কণার অগ্নিগর্ভ মিশ্রণ। বিগ ব্যাংয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এটি তৈরি হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই এটি ঠান্ডা হয়ে প্রোটন ও নিউট্রনে রূপান্তরিত হয়, যেগুলিকে আমরা পদার্থের মূল উপাদান বলে জানি। কণাত্বরক যন্ত্রে যখন আয়ন সংঘর্ষ হয়, তখন সামান্য সময়ের জন্য এই QGP পুনর্নির্মিত হয়। কিন্তু সেটি টিকে থাকে মাত্র $10^{-22}$ সেকেন্ডের মতো। অর্থাৎ এক সেক্সটিলিয়ন (১০ এর ২১ ঘাত)ভাগের এক ভাগ সময়। ততক্ষণে এর তাপমাত্রা কয়েক ট্রিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। এটি এক “আদর্শ ফ্লুইড”-এর মতো আচরণ করে। কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যেই সেই অবস্থা মিলিয়ে যায়।

রোল্যান্ড বলেন, “QGP-কে কখনও সরাসরি দেখা যায় না। দেখা যায় কেবল তার ছাই-ভস্ম। অর্থাৎ সংঘর্ষ থেকে উৎপন্ন কণাগুলিকে আমরা ধরতে পারি। নতুন এই ডিটেকটরের লক্ষ্য হল এই কণাগুলির নিখুঁত পরিমাপ করে QGP-এর বৈশিষ্ট্য পুনর্গঠন করা।” এস ফিনিক্স আসলে পুরনো PHENIX ডিটেক্টরের উন্নত সংস্করণ। ২০২১ সালে এটি স্থাপন করা হয়, আরও দ্রুত এবং সংবেদনশীল প্রযুক্তি দিয়ে। প্রায় দুতলা বাড়ির সমান আকার ও প্রায় এক হাজার টন ওজনের এই যন্ত্র RHIC-এর মূল সংঘর্ষস্থলে বসানো আছে। এখানে প্রতি সেকেন্ডে ১৫ হাজার কণাসংঘর্ষ ধরা যায়।

এর ভেতরে একাধিক স্তর রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম মাইক্রো-ভার্টেক্স ডিটেক্টর। সব মিলিয়ে এই ডিটেক্টর যেন এক বিশাল ত্রিমাত্রিক ক্যামেরা- যা প্রতিটি কণার সংখ্যা, শক্তি এবং গতিপথ ধরে রাখতে পারে। ২০২৪ সালের শরৎকালে তিন সপ্তাহ ধরে চালানো এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এস ফিনিক্স প্রত্যাশিতভাবেই কাজ করছে। গবেষকরা এখন আরও কয়েক মাস সোনার আয়ন সংঘর্ষ ঘটিয়ে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করছেন। এই তথ্য থেকে তারা খুঁজবেন সেই এক-শতকোটি ঘটনার মধ্যে বিরলতম প্রক্রিয়াগুলিকে, যা QGP-এর ঘনত্ব, অতিঘন পদার্থে কণার বিস্তার, কিংবা ভিন্ন কণাকে বাঁধতে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রভৃতি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। সব মিলিয়ে, এই নতুন ডিটেক্টর শুধু একটি নতুন বৈজ্ঞানিক যন্ত্র নয়, এটি সময়-সন্ধানী এক জানালা, যা খুলে দিচ্ছে মহাবিশ্বের প্রথম মুহূর্তের রহস্য। এই রহস্যভেদে প্রতিটি সফল পরিমাপ আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে সেই অগ্নিগর্ভ মুহূর্তের, যেখান থেকে আমাদের সবকিছুর শুরু।

 

সূত্র: The sPHENIX detector is on track to reveal properties of primordial quark-gluon plasma.

Jennifer Chu | MIT News, September 2, 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 6 =