উন্নত মানের কোষপ্রবাহ বিশ্লেষক

উন্নত মানের কোষপ্রবাহ বিশ্লেষক

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জাপানের নারা ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এন এ আই এস টি)-এর গবেষকরা সম্প্রতি এক অভিনব ফ্লো সাইটোমিটার বা কোষ প্রবাহ বিশ্লেষক তৈরি করেছেন। এটি বিজ্ঞানের প্রচলিত নিয়মকে উল্টে দিয়ে “ক্লগিং” বা অতিক্ষুদ্র নালিকায় কণা আটকে যাওয়ার প্রবণতাকেই কাজে লাগিয়েছে। সাধারণত গবেষকরা এটিকে বড় সমস্যা মনে করেন, কারণ এতে কোষ বা কণার প্রবাহ ব্যাহত হয়। কিন্তু এবার সেই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করে আরও নির্ভুল ও সংবেদী বিশ্লেষণ সম্ভব হয়েছে। এই সাফল্য চিকিৎসা, জীববিজ্ঞান ও ওষুধ উদ্ভাবনের ভবিষ্যৎ গবেষণাকে এক নতুন মাত্রা দেবে।
ফ্লো সাইটোমেট্রি বা কোষ প্রবাহ বিশ্লেষণ প্রযুক্তিতে তরল মাধ্যমে থাকা একক কোষ বা কণাকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রতিটি কোষে বিশেষ রাসায়নিক ট্যাগ/ চিহ্নায়ক লাগানো হয়, যা লেজার আলোতে জ্বলে ওঠে। ফলে গবেষকরা খুব দ্রুত কোষের বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে পারেন। কিন্তু এই ট্যাগ প্রস্তুত করতে সময় ও অর্থ দুটোই বেশি লাগে।
তাই এর বিকল্প ইম্পিডেন্স ফ্লো সাইটোমেট্রিতে /বৈদ্যুতিক প্রতিবন্ধকতা ভিত্তিক কোষ প্রবাহ বিশ্লেষণে লেজারের পরিবর্তে তড়িৎদ্বার বা ইলেক্ট্রোড ব্যবহার করা হয়। এখানে কোষ প্রবাহিত হওয়ার সময় বৈদ্যুতিক প্রতিরোধের পরিবর্তন মাপা হয়। এতে ট্যাগের ঝামেলা নেই, তবে বড় সমস্যা হলো—কোষের আকার ও প্রবাহী নালিকার উচ্চতা ভেদে সেন্সরের দূরত্ব বদলে যায়। ফলে সংকেত দুর্বল হয় এবং নির্ভুলতা কমে যায়।
এই সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠতে গবেষক দলটি এক ডাইনামিক মাইক্রোফ্লুইডিক চ্যানেল বা গতিশীল ক্ষুদ্র তরল প্রবাহী নালিকা তৈরি করেছে, যার উচ্চতা ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করা যায়। তারা একটি ধাতব অনুসন্ধানী যন্ত্র ব্যবহার করেছেন, যা XYZ স্টেজের সাহায্যে খুব নিখুঁতভাবে উপরে-নীচে নড়তে পারে।এই ধাতব যন্ত্রের পাতলা মাথাটি মাইক্রোচ্যানেলের ওপরে চাপ দিলে তার উচ্চতা কমে যায়।
প্রায়োগিক ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। চ্যানেলের উচ্চতা এক-তৃতীয়াংশ কমাতেই সংকেত তিনগুণ বেড়ে যায় এবং ভিন্নতা অর্ধেক হয়ে যায়। এতে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের কোষ আলাদা করা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়।
এখানেই গবেষকদের সবচেয়ে বড় সৃজনশীলতা। সাধারণত অতি ক্ষুদ্র নালিকায় কণা জমাট বেঁধে পুরো প্রক্রিয়াটাই বন্ধ হয়ে যায় । কিন্তু তারা ক্যামেরা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক বস্তু নির্ধারক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে এটিকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে তুলেছেন। সামান্য বাধা তৈরি করেই সিস্টেম তার সংবেদনশীলতা বাড়ায়, কিন্তু আসল ক্লগিং শুরু হওয়ার আগেই সেটি মুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে প্রবাহী নালিকাটি এক প্রকার উন্নত কোষ প্রবাহ বিশ্লেষকে রূপ নেয়, যা বাধাকে নিজের কাজে লাগায়।

এই গবেষণা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। খুব শিগগিরই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হতে পারে সহজ, সাশ্রয়ী, অভিযোজনযোগ্য ও জমাট বাঁধা -প্রতিরোধী ‘ইম্পিডেন্স ফ্লো সাইটোমিটার’। চিকিৎসা পরীক্ষাগারে একে ব্যবহার করে দ্রুত ও নির্ভুল কোষ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে। এমনকি রোগীর শয্যাপাশে দ্রুত পরীক্ষা, এবং নতুন ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণায় বিপ্লব ঘটাতে পারে।

গবেষক দলের প্রধান ড. ইয়ালিকুন ইয়াশিয়ার মনে করেন এই নতুন পদ্ধতি কোষীয় প্রবাহ বিশ্লেষণকে এক নতুন মানদণ্ডে পৌঁছে দিয়েছে। এটি শুধু সংবেদী নয়, সহজ, নিয়ন্ত্রিত এবং বহুমুখী। ভবিষ্যতে এটি চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞানে অসংখ্য প্রয়োগের পথ খুলে দেবে।

সূত্র: “A long-term universal impedance flow cytometry platform empowered by adaptive channel height and real-time clogging-release strategy” by Trisna Julian, Tao Tang, et.al; (26.08.2025), Lab on a Chip.
DOI: 10.1039/D5LC00673B

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × one =