
মানব বিবর্তন নিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের ধারণা ছিল যে এটি ধীর, দীর্ঘমেয়াদি এক প্রক্রিয়া যা জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মে এগোয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। নতুন প্রমাণ বলছে, আমাদের ‘কৃষ্টি’ এখন বিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠছে, এবং এই গতি জিনের পরিবর্তনের তুলনায় বহুগুণ দ্রুত। মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টিমোথি এম. ওয়ারিং ও জাকারি টি. উডের মতে, মানব সভ্যতা আজ এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে যেখানে কৃষ্টির প্রভাব জৈবিক বিবর্তনকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। তাদের দাবি, “মানুষ এখন আর শুধু জিনের উপর নির্ভর করে টিকে নেই। বরং কৃষ্টি ও সামাজিক সংগঠনই ভবিষ্যতের বিবর্তনকে নির্ধারণ করছে।” বিবর্তনের ইতিহাসে কৃষির আবির্ভাব এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে আইন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এমনকি প্রযুক্তি সবকিছুই দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের জীবনযাপনকে নতুনভাবে গড়ে দিচ্ছে।
গবেষকরা উদাহরণ টেনে বলেছেন, জিনগত অভিযোজন কখনোই মানুষকে চোখের সমস্যার সমাধান দিতে পারত না। অথচ চশমা, সার্জারি বা উর্বরতা চিকিৎসার মতো কৃষ্টিগত উদ্ভাবন সেই কাজ মুহূর্তেই করছে। অর্থাৎ, কৃষ্টিই মানুষকে এমন সমাধান দিচ্ছে যা জিনগত পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করলে হাজার বছর সময় লেগে যেত। আজ জন্মের সময় পাওয়া জিন নয়, বরং আপনি কোন সমাজে জন্ম নিচ্ছেন, কোন স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় বাস করছেন, বা কোন শিক্ষাব্যবস্থায় বেড়ে উঠছেন-এসব বিষয়ই আপনার ভবিষ্যত জীবন ও সাফল্যের জন্য বেশি নির্ধারক হয়ে উঠছে। সহ-গবেষক উড এক কথায় বিষয়টি বুঝিয়েছেন,“কৃষ্টিগত বিবর্তন এতটাই দ্রুত যে জিনগত পরিবর্তনের ধীরগতি তার কাছে নগণ্য”। এই তত্ত্ব শুধু কল্পনার জগতে আটকে নেই। গবেষকরা গাণিতিক মডেল ও বাস্তব তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন কিভাবে কৃষ্টিগত পরিবর্তন জিনগত পরিবর্তনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, কৃষ্টিগত বিবর্তনের ফল সবসময় ইতিবাচক নাও হতে পারে। যেমন প্রযুক্তির অগ্রগতি অনেককে সুবিধা দিলেও ডিজিটাল বিভাজন বা সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়াতে পারে। তাই কৃষ্টিগত পরিবর্তনকে কিভাবে কাজে লাগানো হবে, সেটাই হয়ে উঠছে বড় প্রশ্ন। যদি কৃষ্টি সত্যিই আমাদের ভবিষ্যতের বিবর্তনের নিয়ন্ত্রক হয়, তবে এর নৈতিক দিক নিয়েও ভাবতে হবে। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় বৈষম্য থাকলে কিছু সমাজ এগিয়ে যাবে, কিছু সমাজ পিছিয়ে পড়বে। গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, “কৃষ্টিগত বিবর্তন যত দ্রুতই হোক, তা সবসময় ভালো ফল দেবে না। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা ছাড়া এটি বৈষম্য বাড়াতে পারে”। মানুষ আর শুধু জীববিজ্ঞানের ধীর প্রক্রিয়ার অধীন নেই। কৃষ্টিগত পরিবর্তন, সামাজিক কাঠামো ও প্রযুক্তিই আজকের বিবর্তনের মূল চালক। অতএব, মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আমরা কিভাবে আমাদের কৃষ্টিকে ব্যবহার করি। শুধু প্রযুক্তির গতি বাড়ানো নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভারসাম্য তৈরি করাই হল আসল চ্যালেঞ্জ।
সূত্র : Cultural inheritance is driving a transition in human evolution by Timothy M Waring,BioScience, biaf094, 15 September 2025.