
গত গ্রীষ্মে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরের বহু অঞ্চলে তাপপ্রবাহ অন্যরকম ছিল। স্থানীয় তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে বন শুকিয়ে যায়। আর প্রতিদিনের জীবন নুয়ে পড়ে অসহ্য গরমে। জলবায়ু পরিবর্তন এই ঘটনাগুলিকে কতটা প্রভাবিত করেছে? জলবায়ুবিদরা নতুন এক গবেষণায় কেবল এই প্রশ্নে থেমে থাকেননি। বরং তারা হিসেব কষেছেন, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ২১৩টি ভয়াবহ তাপপ্রবাহে বিশেষ কিছু জীবাশ্ম জ্বালানি ও সিমেন্ট উৎপাদক সংস্থার অবদান কতটা?
এ গবেষণায় এমন তাপপ্রবাহ বেছে নেওয়া হয়, যেগুলো সরকার ও গণমাধ্যমের নজরে এসেছে, তাদের গুরুতর ক্ষতি বা জরুরি ত্রাণের কারণে। তারা প্রথমে খতিয়ে দেখেছেন মানবসৃষ্ট উষ্ণায়ন কতটা বাড়িয়েছে এসব ঘটনার সম্ভাবনা ও তীব্রতা। এরপর সেই পরিবর্তনগুলিকে যুক্ত করেছেন ১৮০টি বৃহৎ জ্বালানি ও সিমেন্ট কোম্পানির নির্গমনের সঙ্গে। এগুলিকে “ প্রধান কার্বন নির্গমনকারী ” বলা হয়। তাপপ্রবাহ কেবল অস্বস্তির বিষয় নয়। স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে, বিদ্যুৎ সরবরাহে চাপ সৃষ্টি করতে, কৃষি ও শিল্পে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনতে এর গুরুত্ব বিশাল। তাই দায়বদ্ধতার প্রশ্নে শুধু দেশভিত্তিক গড় হিসাব নয়, নির্দিষ্ট উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা জানাও একান্ত জরুরি। এক্ষেত্রে দুটি মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় : প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তন এসব ঘটনার সম্ভাবনা ও তীব্রতা কতটা বাড়িয়েছে? দ্বিতীয়ত, প্রতিটি কোম্পানির নির্গমনের অবদান সেই বৃদ্ধিতে কতটা?
এর জন্য বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন “ইভেন্ট অ্যাট্রিবিউশন” পদ্ধতি। এতে বাস্তব দুনিয়ার তাপমাত্রা ও এক কাল্পনিক প্রাক-শিল্পায়ন বিশ্বের মধ্যে তুলনা করা হয়। এই তুলনায় বোঝা যায়, মানবসৃষ্ট উষ্ণায়ন ছাড়া, ঘটনাগুলির সম্ভাবনা কতটা কম হতে পারতো। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০০০-২০০৯ সালে তাপপ্রবাহের তীব্রতা গড়ে বেড়েছিল প্রায় ১.৪ °সে। সেখানে ২০২০-২০২৩ এ এসে সেই বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.২ °সে। একই সময়ে সম্ভাবনার বৃদ্ধি ছিল আরও নাটকীয়। ২০০০ দশকের প্রথম দিকে যেখানে এমন ঘটনা ২০ গুণ বেশি সম্ভব ছিল, সেখানে ২০১০-২০১৯- এই তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০০ গুণ। ১৮০টি বড় কোম্পানির নির্গমনের প্রভাব খতিয়ে দেখা হয়। ১৪টি কোম্পানির অবদানই বাকি ১৬৬টির সমান। কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের দায় অত্যন্ত বেশি হলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলির অবদানও উপেক্ষা করা যায় না। কারণ সামান্য নির্গমনও বিরল ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে থাকতে পারে। ২০২১ সালের জুনে, উত্তর আমেরিকার প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট অঞ্চলের ‘হিট ডোম’-এর সময় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে। মানবসৃষ্ট উষ্ণায়ন এর কারণ। এমন ঘটনা, শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ে কার্যত অসম্ভব ছিল। নতুন গবেষণা একই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে। ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, তুলনামূলক চিত্র পাওয়া গেছে। গবেষকদের মতে, শিল্পবিপ্লবের আগের তুলনায় তাপপ্রবাহের তীব্রতা যতটা বেড়েছে, তার অর্ধেকের জন্য সরাসরি দায়ী এই ‘প্রধান কার্বন নির্গমনকারী’রা। শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলির অবদান, একেকটি ঘটনায় কয়েক দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছেছে। ই টি এইচ জুরিখ-এর সোনিয়া সেনেভিরত্ন বলেন, “খুব বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান নয়, অল্প কয়েকটিই অধিকাংশ নির্গমনের জন্য দায়ী।” এই বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয়, দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি ব্যক্তি বা দেশের নয়, উৎপাদক কোম্পানির কৌশল ও মুনাফাকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে বেশি জড়িত। এই প্রেক্ষাপটে দায়বদ্ধতার বিষয়টি আইনি। বীমা ও অভিযোজন খরচের আলোচনায় তা নতুন মাত্রা যোগ করছে। কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ুর ঝুঁকি জেনেও ব্যবসা চালিয়ে গেছে অথচ সেই ঝুঁকির প্রকৃত খরচ সমাজকেই বহন করতে হয়েছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু তাপপ্রবাহের তথ্যের ঘাটতির কারণে সেগুলিকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। ফলে প্রকৃত ঝুঁকি কম ধরা পড়েছে। খুব বিরল ঘটনা বা যেখানে পর্যবেক্ষণের রেকর্ড ছোট, সেখানে নির্ভুলতা কম হয়। তবুও গবেষকরা একাধিক মডেল, রাশিতাত্ত্বিক পরীক্ষা ও যাচাইয়ের মাধ্যমে ফলাফলকে মজবুত করেছেন। ভবিষ্যতে এই কাঠামো প্রয়োগ করা হবে বন্যা, খরা ও অরণ্যদাহের মতো অন্যান্য চরম ঘটনার ক্ষেত্রে। এতে পাওয়া যাবে আরও সুনির্দিষ্ট অনুমান ও উন্মুক্ত তথ্য, যা শহর, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও আদালতকে ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করবে।
সূত্র : Systematic attribution of heatwaves to the emissions of carbon majors by Yann Quilcaille, Nature (Published: 10 September 2025)