সগ্দীয় অগ্নিপূজার নতুন তাৎপর্য

সগ্দীয় অগ্নিপূজার নতুন তাৎপর্য

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

২০২২–২০২৩ সালের খনন অভিযানে, তাজাকিস্তানের সঞ্জর-শাহ রাজপ্রাসাদ থেকে এক বিরল দেওয়ালচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, চারজন পুরোহিত ও একটি শিশুর এক শোভাযাত্রা একটি স্থির অগ্নিবেদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্নতাত্ত্বিক মাইকেল শেনকার, শারোফ কুরবানভ ও আব্দুরাহমন পুলোতোভ এই অনন্য শিল্পকর্মের বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন। আধুনিক তাজাকিস্তানের, পানজিকেন্ট শহরের প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এই প্রাসাদ সগ্দীয় জনগোষ্ঠীর। মধ্য এশিয়ার এই জনগণ বর্তমানের উজবেকিস্তান ও তাজাকিস্তানে বসবাস করত। তাদের ছিল নগর-রাষ্ট্রভিত্তিক এক শক্তিশালী সমাজ। বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক, স্বশাসিত নগরজীবন এবং উপনিবেশ গঠনের সুবাদে সগ্দীয়রা খ্যাতি অর্জন করেছিল। সিল্ক রোডের বাণিজ্যে তাদের ছিল কেন্দ্রীয় ভূমিকা।আর চিত্রিত প্রাসাদের দেওয়ালচিত্র আজও, তাদের শিল্পকৌশলের সাক্ষ্য বহন করছে যেন। সঞ্জর-শাহর প্রাসাদটি সম্ভবত পঞ্চম শতাব্দীতে গড়ে ওঠে। তবে কয়েক শতাব্দী পর, উমাইয়া গভর্নর নাসর ইবনে সাইয়ারের শাসনকালে এটি নগরকেন্দ্রে পরিণত হয়। পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই প্রাসাদটি সম্ভবত পানজিকেন্টের শেষ শাসকের বাসভবন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এখানে চীনা আয়না, স্বর্ণখচিত বেল্টের বকলস-সহ বিলাসবহুল সামগ্রী পাওয়া গেছে। যা থেকে বোঝা যায়, অধিবাসীদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ও বাণিজ্যিক সংযোগ ছিল। অন্য সগ্দীয় প্রাসাদের মতো এটিতেও ছিল বিষম বিন্যাসে তৈরি অভ্যর্থনাকক্ষ -একটি টি-আকৃতির করিডরকে ঘিরে সাজানো। প্রাসাদটি অষ্টম শতাব্দীর তৃতীয় ভাগে আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে এটি কৃষকদের দ্বারা পুনঃব্যবহৃত হয়। সাসানীয় আমলের (৮১৯–৯০০ খ্রিস্টাব্দ) প্রথম দিক পর্যন্ত তারা এখানেই বসবাস করত। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে বিভিন্ন দেওয়ালচিত্রের টুকরো উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে করিডরের দেওয়ালে আঁকা নীল পদ্মফুল, কক্ষ ৫–এ শিকারের দৃশ্য, এবং আয়তক্ষেত্রাকার কক্ষে যুদ্ধদৃশ্যের সম্ভাব্য অংশ, যেখানে অশ্বারোহী যোদ্ধা ও দানবাকৃতি চরিত্র দেখা যায়।
কিন্তু সবচেয়ে ব্যতিক্রমী নিদর্শন হলো, সম্প্রতি আবিষ্কৃত অগ্নিপূজার চিত্র। প্রায় ৩০টি খণ্ডে বিভক্ত এই দেওয়ালচিত্রে দেখা যায়—চারজন পুরোহিত ও একটি শিশু অগ্নিবেদীর দিকে এগিয়ে চলেছে। এ ধরনের অগ্নিবেদীমুখী শোভাযাত্রা এতদিন কেবল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটেই পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে সাধারণত দুটি পুরোহিতকে চিত্রিত করা হত। এখানে, প্রথম পুরোহিতকে দেখা যায় অগ্নিবেদীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটি ক্ষুদ্র বেদী উৎসর্গ করতে, যা সগ্দীয় শিল্পে ধূপ নিবেদন রূপে পরিচিত। তৃতীয় পুরোহিতের মুখে আঁকা হয়েছে ‘পাদাম’ অর্থাৎ একটি বিশেষ মুখোশ। যা আজও জরথুষ্ট্রীয় পুরোহিতরা ব্যবহার করেন। পুরোহিতের নিঃশ্বাস যাতে পবিত্র আগুনকে অপবিত্র না করে, সেটাই এই মুখোশের উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় পুরোহিতের মুখোশ হারিয়ে গেলেও হয়তো তিনিও পাদাম পরেছিলেন। তবে তার গলায় একটি অনন্য ফিতা দেখা যায়। যা বর্তমানে ব্যাখ্যাতীত। শেনকারের ভাষায়, “এই ফিতাটি সাধারণত দেবত্ব বা রাজকীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে এর উপস্থিতি জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করছে।” এই অগ্নিপূজার চিত্রটি অনন্য, কারণ এটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-প্রসঙ্গের বাইরে প্রথম উদাহরণ। এটি সগ্দীয় পুরোহিতদের পোশাক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়। আর সেই সঙ্গে জরথুষ্ট্রীয় অগ্নিপূজা কীভাবে এই অঞ্চলে চর্চিত হতো তারও প্রমাণ মেলে ধরে।
সগ্দীয় দেওয়ালচিত্রগুলি দীর্ঘদিন ধরে তাদের শিল্প ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে সঞ্জর-শাহ প্রাসাদের এই নতুন আবিষ্কার তাদের ধর্মীয় জীবন ও আচারপদ্ধতি সম্পর্কে একেবারে নতুন আলো ফেলেছে।

সূত্র: Michael Shenkar et al, A unique scene of fire worship from the late Sogdian palace at Sanjar-Shah, Antiquity (2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten + 18 =