
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তর হলো এক্সোস্ফিয়ার, যা ৩০০ মাইল ওপর থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়। এটি মূলত হাইড্রোজেন গ্যাসের এক বিশাল, অদৃশ্য মেঘ যা পৃথিবীর চারপাশে এক প্রকার হালকা, অদভূতুড়ে আভা তৈরি করে। অস্তিত্ব থাকলেও চোখে ধরা পড়ে না এই আভা। সুতরাং তাত্ত্বিকভাবে এই আভার উপস্থিতি বিজ্ঞানীরা বুঝলেও বাস্তবে তা তাঁদের চোখে ধরা দেয় নি। তবে ১৯৭২ সালে বিজ্ঞানী জর্জ ক্যারাদারস প্রথম এর প্রমাণ পান। তিনি এক বিশেষ অতিবেগুনি ক্যামেরা তৈরি করেছিলেন, যা অ্যাপোলো ১৬ মিশনে চাঁদে বসানো হয়েছিল। সেই ক্যামেরায় তোলা ছবিতে দেখা যায়, পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে হাইড্রোজেনের আলোকিত আভা।
আজ প্রায় ৫০ বছর পর নাসা তাঁর সম্মানে ক্যারুথার্স জিওকরোনা অবজারভেটরি নামক একটি মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করছে, যার লক্ষ্য পৃথিবীর এক্সোস্ফিয়ারকে বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করা। মহাকাশযানটি শুধু ছবি নয়, বরং চলমান ভিডিও ধারণ করবে, যা দেখাবে কিভাবে এক্সোস্ফিয়ার সৌর ঝড় ও অন্যান্য মহাকাশীয় আবহাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানায়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর এক্সোস্ফিয়ার কমপক্ষে চন্দ্রলোকের অর্ধেক পথ পর্যন্ত বিস্তৃত। এক্সোস্ফিয়ার হলো পৃথিবীর ঢাল, যা প্রথম আঘাত সয় সৌরঝড় ও সৌর বিকিরণের । এসব ঝড় কৃত্রিম উপগ্রহ নষ্ট করতে পারে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত করতে পারে, এমনকি মহাকাশচারীদেরও ক্ষতি করতে পারে। এক্সোস্ফিয়ার কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তা বোঝা গেলে এসব বিপদ আগে থেকে অনুমান করা সহজ হবে।
তাছাড়া, এখান দিয়েই হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি মহাশূন্যে হারিয়ে যায়। যেহেতু হাইড্রোজেন জলের অন্যতম প্রধান উপাদান বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী কীভাবে জল ধরে রাখতে পেরেছে অথচ মঙ্গল বা শুক্র তা হারিয়েছে তার উত্তর লুকিয়ে আছে এই স্তরে। ফলে আর কোন কোন বহির্জাগতিক গ্রহগুলোতে জীবনের সম্ভাবনা থাকতে পারে সেটা বোঝার ক্ষেত্রেও মিশনটি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যারুথার্স মহাকাশযানটি আকারে একটি ছোট সোফার মতো, ওজন প্রায় ২৪০ কেজি। এটি ২০২৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ফ্যালকন ৯ রকেটে চড়ে মহাকাশে পাড়ি দিল। এর সঙ্গী নাসার আই এম এ পি ও এন ও এ এ-র SWFO-L1। প্রায় চার মাসের যাত্রার পর তিনটি মহাকাশযান পৌঁছাবে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট-১ (L1)-এ যা পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে প্রায় ১৬ লাখ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
সেখান থেকে ক্যারুথার্স তার দুটি বিশেষ অতিবেগুনি ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করবে এক্সোস্ফিয়ারের পূর্ণ ছবি ও ভিডিও। এক ক্যামেরা কাছ থেকে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ধরবে, আরেকটি দূর থেকে দেখাবে পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা হাইড্রোজেন আভা।
এই মিশনটি পৃথিবী তো বটেই, অন্যান্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলও কিভাবে মহাশূন্যে হারিয় যায় তা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৬ সালের মার্চ থেকে এটির পূর্ণ বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম শুরু হবে। তখন প্রথমবারের মতো আমরা দেখতে পাব পৃথিবীর এই অদৃশ্য সীমানার বাস্তব চলমান ছবি যা আমাদের গ্রহটিকে সূর্যের তীব্র শক্তির মাঝেও টিকে থাকতে সাহায্য করে।
ক্যারুথার্স মিশন পৃথিবীর এক্সোস্ফিয়ার নিয়ে মানবজাতির প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান, যা আমাদের গ্রহ ও সৌরজগতের বাইরের গ্রহের ভবিষ্যৎ বোঝার ক্ষেত্রে নতুন পথ দেখাবে।
সূত্র : Carruthers Geocorona Observatory Blog (September 23rd , 2025).