চাঁদের দুই পিঠ

চাঁদের দুই পিঠ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

চাঁদের এক পৃষ্ঠ আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা যায়, অন্যদিকের পৃষ্ঠটি চির অদৃশ্য। এই কারণে বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘অন্তরাল দিক’ বা ‘আড়ালভাগ’। বহু দশকের ধারণা, চাঁদের এই গোপন অংশটির গঠন এবং অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা হয়তো দৃশ্যমান দিকটির তুলনায় ভিন্ন। কিন্তু এর কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ এতদিন ছিল না। সম্প্রতি, চীনের মহাকাশ সংস্থা থেকে পরিচালিত চ্যাং’ই-৬ অভিযানের মাধ্যমে সেই অদৃশ্য পৃষ্ঠ থেকে প্রথমবারের মতো শিলা ও মাটি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে আনা হয়েছে। নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা চমকপ্রদ একটি সত্যের ইঙ্গিত পেয়েছেন। চাঁদের অন্তরাল পৃষ্ঠ ভৌগোলিক ও গঠনগতভাবে তুলনামূলক ঠাণ্ডা, অর্থাৎ সেখানে অভ্যন্তরীণ তাপ কম। ২০২৪ সালে উৎক্ষেপণ করা চ্যাং’ই-৬ মহাকাশযান চাঁদের আড়ালভাগ-এ অবতরণ করে। সেখান থেকে প্রায় ৩০০ গ্রাম শিলা ও ধূলিকণা সংগ্রহ করে। এটিই ইতিহাসে প্রথম। শিলা নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এগুলির বয়স প্রায় ২৮০ কোটি বছর। গঠনগত বিশ্লেষণে জানা যায়, উৎপত্তির সময় এগুলির তাপমাত্রা ছিল প্রায় ১১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ চাঁদের দৃশ্যমান দিকের একই ধরণের শিলা সাধারণত ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে গঠিত হয়। অর্থাৎ, অন্তরাল পৃষ্ঠে শিলাগুলো গঠিত হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রায়।এবং এটি ইঙ্গিত দেয় চাঁদের এই অংশটির অভ্যন্তরীণ তাপশক্তি কম। আবিষ্কারটি শুধুই একটি তাপমাত্রার পার্থক্য ঘটিত নয়। এটি চাঁদের ভেতরের গঠন ও ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলেন, চাঁদের অভ্যন্তরে এমন কিছু তেজস্ক্রিয় উপাদান রয়েছে, যেমন ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম ও পটাসিয়াম, যেগুলোর অবক্ষয়ের মাধ্যমে এই তাপ উৎপন্ন হয়। এসব উপাদান যদি চাঁদের একদিকে বেশি ঘনীভূত থাকে, তাহলে অংশটি স্বাভাবিকভাবেই বেশি গরম থাকবে। এই ধরনের উপাদান একত্রে ‘ক্রিপ’ নামে পরিচিত। যার পুরো অর্থ: পটাসিয়াম (K), বিরল-মাটি উপাদান (REE), এবং ফসফরাস (P)। গবেষণায় দেখা গেছে, উপাদানগুলি মূলত চাঁদের দৃশ্যমান দিকেই বেশি রয়েছে। যার জন্য ঐ অংশে বেশি আগ্নেয়গিরি ঘটিত কার্যকলাপ ঘটে আর এটিকে তুলনামূলকভাবে উষ্ণ থাকে । অন্যদিকে, চাঁদের অন্তরাল পৃষ্ঠে এ ধরনের তাপ-উৎপাদক উপাদানের ঘনত্ব কম থাকায়, সেখানে কম তাপমাত্রায় শিলা গঠিত হয়েছে। চাঁদের বিভিন্ন অংশের উপর নজর রাখা মহাকাশ উপগ্রহের তথ্যও এই পার্থক্যকে সমর্থন করে। চ্যাং’ই-৬ যেখানে অবতরণ করেছিল সেই অঞ্চলের তাপমাত্রা ও ভূগঠন বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ঐ অংশে শীতলতা বেশি। বিজ্ঞানীরা এই বৈষম্যের পেছনে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ দেখিয়েছেন।
১)চাঁদের গঠনের সময় তেজস্ক্রিয় উপাদান সমভাবে বন্টিত হয়নি।
২) একটি বড় মহাজাগতিক বস্তুর সংঘর্ষ চাঁদের গঠন ও তাপ-বণ্টনে প্রভাব ফেলেছে।
৩)চাঁদ যখন পৃথিবীর অভিকর্ষে ধরা পড়ে, সেই মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবও এক দিকের অভ্যন্তর থেকে উপাদান সরে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
এই গবেষণা শুধু চাঁদের গঠন নয়, বরং পুরো সৌরজগতের উপগ্রহ ও গ্রহগুলোর গঠনপ্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

সূত্র : A relatively cool lunar farside mantle inferred from Chang’e-6 basalts and remote sensing; Nature Geoscience; Published: 30 September 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 + fourteen =