
পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের অস্থিরতার সঙ্গে হৃদরোগের সরাসরি সম্পর্ক থাকতে পারে। সম্প্রতি ব্রাজিলে পরিচালিত একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় এমন এক সম্ভাব্য সংযোগের ইঙ্গিত মিলেছে। পৃথিবী এক অদৃশ্য চৌম্বক ঢালের আবরণে ঘেরা। এই চৌম্বক স্তরই আমাদের গ্রহকে সূর্য থেকে আগত তীব্র কণাস্রোত ও বিকিরণের আঘাত থেকে রক্ষা করে। তবে সূর্যের পৃষ্ঠে যখন প্রবল শক্তি-বিস্ফোরণ ঘটে, তখন তা সৌরঝড়ে পরিণত হয়। সেই প্রবল কণাস্রোত পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রকে সাময়িকভাবে বিঘ্নিত করে। প্রশ্ন হলো, এই মহাজাগতিক ঘটনার কোনো প্রভাব কি মানুষের শরীরে, বিশেষত হৃদযন্ত্রে পড়তে পারে? ব্রাজিলের গবেষকরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই উদ্যোগ নেন। বিজ্ঞানীরা ব্রাজিলের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে বহু বছরের তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্যভাণ্ডারে হৃদরোগে আক্রান্ত বা হৃদ বৈকল্যে মৃত রোগীদের রেকর্ড ছিল। একই সময়ে সূর্যের কার্যকলাপ ও পৃথিবীর চৌম্বক পরিবর্তনের তথ্যও তাঁরা বিশ্লেষণ করেন। চৌম্বক অস্থিরতার মাত্রা নির্ধারণে ব্যবহৃত কে পি সূচক দ্বারা জানা যায়, নির্দিষ্ট দিনে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র কতটা শান্ত, মাঝারি বা অস্থির ছিল। গবেষকরা প্রতিটি দিনের জন্য এই সূচক ও রোগীদের বয়স, লিঙ্গ এবং হাসপাতাল থেকে বেঁচে ফেরা বা মৃত্যুর তথ্য মিলিয়ে দেখে পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ চালান। তাতে ধাপে ধাপে দেখা হয়, শান্ত চৌম্বক দিন, মাঝারি দিন ও বিঘ্নিত দিনগুলিতে হৃদরোগের ঘটনা কীভাবে পরিবর্তিত হয়। দেখা যাচ্ছে, যখন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সৌরঝড়ের দরুন অস্থির হয়ে ওঠে, তখন মধ্যবয়স্ক ও প্রবীণা নারীদের মধ্যে হৃদরোগ ও হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া-বৈকল্যর ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। শান্ত দিনের তুলনায় সেই হার প্রায় তিনগুণ বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রেও হৃদরোগের সংখ্যা বেশি হলেও, চৌম্বক বিঘ্নিত দিনে তা খুব উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। কিন্তু ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে পার্থক্যটি ছিল পরিসংখ্যানগতভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অন্য একটি বিশ্লেষণেও দেখা যায়, চৌম্বক অস্থিরতার সময়কালে হাসপাতালে মৃত্যুর হার বেশি, বিশেষত ৬০ বছরের কাছাকাছি বয়সের মহিলাদের মধ্যে। তবে গবেষকরা সতর্কভাবে বলেছেন, এটি একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা মাত্র। অর্থাৎ এখানে কেবল মিলই পাওয়া গেছে, তার কারণ ও ফলাফলের সম্পর্ক নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয়। মানবদেহের অনেক প্রক্রিয়াই সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক কাজকর্মের ওপর নির্ভরশীল। হৃদস্পন্দন, স্নায়ু সংকেত, রক্তনালীর সংকোচন-প্রসারণ – এই সবকিছুই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন সেই সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াগুলির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, এমন ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিছু গবেষকের মতে, বাইরের এই চৌম্বক পরিবর্তন শরীরে অতি সূক্ষ্ম “ঠেলা” তৈরি করতে পারে—যা হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ আগে থেকেই দুর্বল বা অস্থিতিশীল থাকলে সেটিকে বিপজ্জনক দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। তবে এই গবেষণায় সেই ধরণের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া সরাসরি পরিমাপ করা হয়নি; এটি কেবল সময়ের সঙ্গে মিল-খোঁজার মাধ্যমে সম্পর্ক নির্দেশ করেছে। এই সম্ভাব্য সম্পর্ক যাচাই করতে আরও বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশ, জলবায়ু ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ডেটা তাতে যুক্ত থাকবে। তাপমাত্রা,বায়ুদূষণ, জীবনধারা,ওষুধ-ব্যবহার—এই সব ভিন্ন ভিন্ন উপাদানও বিশ্লেষণের অন্তর্ভুক্ত হবে। যদি ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, তবে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তা একটা বড় ভূমিকা নিতে পারে।
সূত্র : Influence of geomagnetic disturbances on myocardial infarctions in women and men from Brazil by Luiz Felipe C. Rezende,et.el ; 1st july, 2025