ব্যাকটেরিয়ার কোষে অজানা নলাকার গঠন

ব্যাকটেরিয়ার কোষে অজানা নলাকার গঠন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ অক্টোবর, ২০২৫

পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবজগৎ আজও যতটা রহস্যে মোড়া, ততটাই বিস্ময়কর। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এমন এক অভূতপূর্ব জৈব কাঠামো, যা আগে কখনো কোনো সপ্রাণ জীবে দেখা যায়নি। নলাকার এই সূক্ষ্ম গঠনটি লুকিয়ে আছে এক ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া ক্যান্ডিডেটাস প্রফটেলা আর্মাটুরা-র ভিতরে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ব্যাকটেরিয়ার নিবাস অ্যাশিয়ান সিট্রাস সাইলিড নামক এক ছোট্ট পোকার শরীরে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ব্যাকটেরিয়াটির কোষের ভেতর যে নলাকৃতি গঠনটি পাওয়া গেছে, সেটি এতটাই জটিল ও সংগঠিত যে বিজ্ঞানীরা হতবাক! এই ক্ষুদ্র সাইলিড পোকাটিই সারা বিশ্বে সিট্রাস গ্রিনিং ডিজি ছড়ানোর জন্য পরিচিত। এতে হাজার হাজার লেবু, কমলালেবু ও নানান ফলের বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের আড়ালে তার শরীরে বাসা বেঁধে আছে এক সহবাসী ব্যাকটেরিয়া- প্রফটেলা, যা মায়ের দেহ থেকে সন্তানের দেহে ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এই ব্যাকটেরিয়া তার পোষক পোকাকে রাসায়নিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বিষাক্ত যৌগ তৈরি করে, যা শিকারিদের দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু এবার দেখা গেল, প্রফটেলা-র নিজের শরীরেই গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত, সর্পিল নলাকার গঠন, যা একেবারে অচেনা। ত্রি-মাত্রিক ইলেকট্রন অনুবীক্ষণে প্রফটেলা কোষগুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার অভ্যন্তরে রয়েছে একাধিক দীর্ঘ, পাকানো নল (helical tubes)।
প্রতিটি নল প্রায় ২০–৩০ মাইক্রোমিটার লম্বা – অর্থাৎ একটি ব্যাকটেরিয়ামের শরীরের প্রায় অর্ধেক! আর ব্যাস মাত্র ২৩০ ন্যানোমিটার। এটি মানুষের চুলের প্রস্থের প্রায় এক-হাজার ভাগের এক ভাগ। বিজ্ঞানীদের বর্ণনায়, প্রতিটি নল ৫–৬টি সর্পিল তন্তু দ্বারা গঠিত, যেন কোনো ক্ষুদ্র স্প্রিং বা পাকানো দড়ি। এই নলগুলির ভিতর প্রোটিন-উৎপাদক রাইবোসোম কণিকাও দেখা গেছে। অর্থাৎ এই কাঠামোগুলি হয়তো কোষের ভেতর প্রোটিন তৈরির সক্রিয় কেন্দ্র।
গবেষকদের ভাষায়, ” এই নলগুলো যেন ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে ছোট ছোট ‘মিনি ফ্যাক্টরি’ যেখানে জৈব প্রক্রিয়া, প্রোটিন উৎপাদন, কিংবা রাসায়নিক পরিবহন একসঙ্গে ঘটছে।
এটি ব্যাকটেরিয়া জগতে এক অপ্রত্যাশিত স্থাপত্যগত জটিলতা, যা এতদিন কেবল ইউক্যারিওটিক (জটিল কোষবিশিষ্ট) জীবের মধ্যেই দেখা যেত।এমন পাকানো নল আমরা কোনো জীবন্ত ব্যাকটেরিয়ায় আগে কখনো দেখিনি,” বলেছেন এক গবেষক। “এটা যেন কোষের ভেতরে তৈরি জৈব কুণ্ডলী, যা নিজে নিজেই কাজ করছে।”এই আবিষ্কার ব্যাকটেরিয়ার বিবর্তন সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। এই নলাকার গঠন কি পোকা-নির্ভর জীবনের অভিযোজন হিসেবে উদ্ভূত? নাকি অন্য সহবাসী ব্যাকটেরিয়াতেও এমন কাঠামো আগে থেকেই ছিল, যা এতদিন চোখে ধরা পড়েনি? যদি উত্তর দ্বিতীয়টি হয়, তবে হয়তো ব্যাকটেরিয়ার জগৎ আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি স্থাপত্যগত অর্থে সংগঠিত। এ ঘটনা মানব জীববিদ্যার ধারণা পুরো পাল্টে দিতে পারে। “সরল জীব” বলে আমরা যে ব্যাকটেরিয়াকে জানি, তারা আসলে জটিল জীবপ্রযুক্তির বাহক। প্রফটেলা-র এই নলাকার গঠন শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়, কৃষিক্ষেত্রেও এক সম্ভাবনার আলো। বিশেষত বিষাক্ত কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে। একবিংশ শতাব্দীর মাইক্রোবায়োলজি যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ন্যানোটেকনোলজির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, তখন এই আবিষ্কার যেন জীবজগতের গভীরতম রহস্যে উঁকি দেওয়ার এক জানালা খুলে দিল।

সূত্র : Enigmatic tubular ultrastructure in the bacterial defensive symbiont of the Asian citrus psyllid Diaphorina citri by Chihong Song; et.el Npj imaging. Published: 18 September 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × five =