বুদ্ধিমান পাতা-কাটা পিঁপড়ে

বুদ্ধিমান পাতা-কাটা পিঁপড়ে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ অক্টোবর, ২০২৫

পানামার ঘন বর্ষারণ্যে প্রতিদিনই দেখা যায় এক অদ্ভুত দৃশ্য । মনে হয় মাটির ওপর ছোট ছোট সবুজ টুকরো যেন নড়াচড়া করছে, যেন নিজে নিজেই হাঁটছে। আসলে কিন্তু সেই পাতার নীচে লুকিয়ে থাকে কর্মঠ পাতাকাটা পিঁপড়েরা। তারা গাছের পাতা, ফুল ও পাপড়ি কেটে লাইন করে একনাগাড়ে নিজেদের ভূগর্ভ খামারে নিয়ে চলে , খাদ্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে।
তবে এই নিখুঁত দলগত পরিশ্রমের মধ্যেও আছে এক অদ্ভুত সমস্যা। অনেক সময় এই পিঁপড়েরা তাদের পথ সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসটিআরআই) -এর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, যখন পিঁপড়েরা অতিরিক্ত ভারী পাতা বহন করে, তখন তাদের শুঁড়ের কাজ ব্যাহত হয়। তার ফলে তৈরি হয় একধরনের অদৃশ্য কোণ যা দেখা যায় না, বোঝা যায় না। এ অনেকটা ভারী ট্রাক চালকের মতো, যে আয়নায় পেছনের দৃশ্য পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না।
পাতা – কাটা পিঁপড়েরা অসাধারণ শক্তিশালী। তারা নিজেদের ওজনের আটগুণ পর্যন্ত ভারী পাতা তুলতে পারে। কিন্তু একবার গতি কমে গেলে, পেছনের পিঁপড়ের সারিও আটকে পড়ে। একে বলে “ট্রাক ড্রাইভার এফেক্ট”, যেখানে ভারী বোঝা সবার গতিকে ধীর করে দেয়।
এই ধীরগতির কারণ খুঁজতে বিজ্ঞানী সাবরিনা আমাডর ও গবেষক ক্যাথরিন পোরাস পিঁপড়ের চলাফেরা ভিডিও করেছেন। দেখা গেছে, যারা ভারী পাতা বহন করছে তারা মাটিতে শুঁড় কম ছোঁয়াচ্ছে। অর্থাৎ ভারী বোঝা তাদের অনুভবের যোগাযোগ ব্যাহত করছে।
পিঁপড়েরা দৃষ্টিশক্তি ছাড়াও রাসায়নিক সংকেত বা গন্ধ অনুসরণ করে চলে, আর শুঁড় দিয়ে সেই পথ অনুভব করে। কিন্তু বড় পাতা তাদের শুঁড়ের নড়াচড়া আটকে দেয়, ফলে পথচলা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
এরপর গবেষকরা পিঁপড়েদের মিষ্টি কমলার রস মাখানো ছোট ছোট কাগজের টুকরো দিলেন। পিঁপড়েরা যখন সেটি নিয়ে হাঁটছিল, তখন হঠাৎ কাগজটি অর্ধেক কেটে দেওয়া হল। দেখা গেল, ভার কমার সঙ্গে সঙ্গে পিঁপড়ের শুঁড় দিয়ে মাটি স্পর্শ করার গতি বেড়ে গেল। অর্থাৎ, হালকা বোঝা তাদের অনুভূতির তাল ফিরিয়ে আনল।
এই পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো, ভারী বোঝা পিঁপড়ের সংবেদনশক্তি ব্যাহত করে, ফলে তারা পথ হারায় ও ধীরে চলে। তাই অনেক পিঁপড়ে ইচ্ছে করেই ছোট পাতা বহন করে, যাতে চলাচলে সমস্যা না হয়। প্রমাণিত হল যে , পাতা- কাটা পিঁপড়েরা কেবল শক্তিশালীই নয়, দারুণ বুদ্ধিমানও। তারা বুঝে গেছে বেশি ভার মানেই বেশি সফল যাত্রা নয়। হালকা পাতা বহন করলে তারা দ্রুত চলতে পারবে। যারা হালকা পাতা বহন করে, তারা দ্রুত ও সঠিকভাবে চলতে পারে, ফলে পুরো বসতির কাজ মসৃণ হয়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধারণা মানুষও ব্যবহার করতে পারে — যেমন রোবট, ড্রোন ব্যবস্থায়, যেখানে সেন্সর অতিরিক্ত বোঝায় বাধা পায়, ঠিক পিঁপড়েদের মতোই।
এই ক্ষুদ্র শ্রমিকরা আমাদের শেখালো, দক্ষতা মানে ভার কমিয়ে বুদ্ধি করে এগোনো, ভার বাড়িয়ে হারিয়ে যাওয়া নয়। অর্থাৎ, কেবল শক্তি নয়, সচেতনতা আর ছন্দ বজায় রাখাই সাফল্যের চাবিকাঠি।

সূত্র: Carrying oversized loads may create “blind spots” in leafcutter ants by Katherine Porras-Brenes &Sabrina Amador-Vargas, published in the journal Insectes Sociaux,(27.09.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 + 10 =