ধীরে-সিদ্ধ ডিমের কেরামতি

ধীরে-সিদ্ধ ডিমের কেরামতি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

ডিম সিদ্ধ করা এক সূক্ষ্ম কৌশল। ডিমের সাদা অংশ ও কুসুমের সঠিক তাপমাত্রা ঠিক রাখা এক কঠিন বিজ্ঞান। নতুন গবেষণা জানাচ্ছে, পুষ্টিসমৃদ্ধ ও নরম স্বাদের ডিম একেবারে পরীক্ষাগারে নির্ণয় করে তৈরি করা যায়।ডিমের ভেতর দুটি অংশ, একেবারেই আলাদা দুই জগৎ। সাদা অংশ (অ্যালবুমেন) ও কুসুম (ইয়োক)। সমস্যার মূল এখানেই। সাদা অংশ জমে ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অথচ কুসুম শক্ত হতে শুরু করে মাত্র ৬৫ ডিগ্রিতেই। ফল? ফুটন্ত জলে (১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ডিমের সাদা অংশ ঠিকঠাক শক্ত হয়, কিন্তু কুসুম শক্ত হয়ে যায় অতিরিক্ত। তাই সুসিদ্ধ ডিম প্রকৃতপক্ষে এক জটিল তাপ-সমীকরণের পরিণাম। কেউ কেউ ‘সু-ভিড’ নামে পরিচিত ধীর সিদ্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি তাপে এক ঘণ্টা ধরে ডিম সিদ্ধ করা। এতে কুসুম মোলায়েম থাকে, কিন্তু সাদা অংশ অনেক সময় কাঁচা বা অস্বাভাবিক জেলির মতো হয়ে যায়। ফলে নিখুঁত ফল মেলে না।

ইতালির ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের গবেষক পেলোগ্রিনো মুস্টো ও তাঁর সহকর্মীরা এই সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধান খুঁজেছেন। তাঁরা কম্পিউটার ভিত্তিক ‘তরল-প্রবাহ বিশ্লেষণ’ (কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডাইনামিক্স) ব্যবহার করে ডিমের ভিতরে কীভাবে তাপ ছড়ায় তা গণনা করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় ফুটন্ত জল ও ঠান্ডা জলের মধ্যে ডিমকে বারবার স্থানান্তর করা হয়। প্রতি দুই মিনিট পর ডিমটি গরম জল থেকে ঠান্ডা জলে, আবার ঠান্ডা জল থেকে গরম জলে ফেরানো হয়। এভাবে মোট ৩২ মিনিট সময় ধরে ডিম সিদ্ধ করা হয়। গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ধীরে সিদ্ধ করার পদ্ধতিতে কুসুমের তাপমাত্রা প্রায় স্থায়ীভাবে ৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে। তাতে, তার গঠন বজায় রাখে অথচ নরমভাবও বজায় থাকে। সাদা অংশের তাপমাত্রা সময়ের সঙ্গে ওঠানামা করে, ফলে তা শক্ত হলেও রাবারের মতো শক্ত হয় না। অর্থাৎ ডিমের দুই অংশই একসঙ্গে ‘সঠিক মাত্রায়’ সিদ্ধ হয়। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে, এইভাবে সিদ্ধ করা ডিমের কুসুম থাকে মোলায়েম, হালকা ঝরঝরে ও সুস্বাদু। এক কথায়, দেখতে ও খেতে দুই দিক থেকেই আদর্শ। বিজ্ঞানীরা শুধু স্বাদে থেমে থাকেননি। তারা উন্নত যন্ত্রের মাধ্যমে (নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেসোন্যান্স ও উচ্চ রেজোলিউশন ভর-বর্ণালি বিশ্লেষণ) এই সিদ্ধ ডিমের রাসায়নিক গঠন পরীক্ষা করেছেন। দেখা গেছে, ধীরে সিদ্ধ করা ডিমে ‘পলিফেনল’ নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগের মাত্রা বেশি। এটি কোষরক্ষা ও প্রদাহ-নাশে সহায়ক। গবেষকদের ধারণা, ধীরে ধীরে তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে ডিমের ভিতরে এই উপাদানগুলি নষ্ট না হয়ে স্থিতিশীল থাকে বা নতুনভাবে রূপ নেয়। অর্থাৎ ধীরে সিদ্ধ করা ডিম কেবল স্বাদে নয়, পুষ্টিতেও এগিয়ে। এই পদ্ধতি আপাতত সময়সাপেক্ষ, কিন্তু গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে এটি স্বয়ংক্রিয় রান্না-যন্ত্রের মাধ্যমে সহজেই প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। এতে শুধু রাঁধুনিরা নয়, খাদ্যশিল্পই পেতে পারে এক নতুন বৈজ্ঞানিক উপহার। যেখানে নিখুঁত সিদ্ধ ডিম তৈরি হবে একদম ঘড়ির মতো অভ্রান্ততায়। অর্থাৎ, তাড়াহুড়ো নয়, ধৈর্যই এখানে মূল উপাদান।

 

সূত্র : The perfect, but slow, way to boil an egg – according to science; 6 February 2025 by Jasmin Fox-Skelly

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 5 =