জলবায়ু বদল, রাজনীতি, প্রচারমাধ্যম

জলবায়ু বদল, রাজনীতি, প্রচারমাধ্যম

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

মানুষ যতদিন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি না হয়, ততদিন জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব সহকারে অনুভব করতে চায় না। ভাবে এ কোনো দুরবর্তী ভবিষ্যৎ, এখন একে বেশি গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই।কিন্তু একবার যদি নিজের চোখে দেখে নদী উপচে ঘর ভেসে যাচ্ছে, কিংবা সূর্যের তাপে মাটি ফেটে চৌচির,তখনই টের পায় জলবায়ু পরিবর্তন সত্যিই জীবনের অংশ হয়ে গেছে।

এই বাস্তব উপলব্ধির পেছনে রয়েছে এক বিশাল আন্তর্জাতিক গবেষণা, যেটির পরিচালনা করেছেন অ্যামস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফ্যাবিয়ান ডাবল্যান্ডার। তাঁর নেতৃত্বে ১৪২টি দেশের ১,২৮,০০০ মানুষকে নিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, যারা নিজের জীবনে জলবায়ুজনিত বিপর্যয় ভোগ করেছেন, তারা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনকে দেখেন। ডাবল্যান্ডার বলেন, ব্যক্তিগতভাবে ঠেকে শেখা, দেখে শেখার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী। যখন কেউ নিজে বন্যা বা তাপপ্রবাহের শিকার হয়, তখন জলবায়ুর ঝুঁকি হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন জলবায়ু পরিবর্তন আর দূরের কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়, বরং এক বাস্তব, স্পর্শযোগ্য বিপদ রূপে গণ্য হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, তাপপ্রবাহ মানুষের মানসিক উপলব্ধিতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনে। যারা চরম গরমের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনকে অত্যন্ত গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখার প্রবণতা কয়েকগুণ বেশি। বন্যা বা খরাও মানুষের চিন্তাকে বদলে দেয়, তবে দেশভেদে এর প্রভাব আলাদা। অন্যদিকে, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল বা ভূমিধসের মতো ঘটনাগুলো প্রায় সব অঞ্চলেই একইভাবে মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সহজ ভাষায়, প্রকৃতির একটিমাত্র আঘাতই মানুষের ভেতরে ভয়, উপলব্ধি আর পরিবর্তনের বীজ বপন করে দেয়।

তবে গবেষণাটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈপরীত্যও দেখা গেছে যে, যেসব দেশে দুর্যোগ বেশি, সেখানে সবসময় জলবায়ু নিয়ে উদ্বেগ বেশি নয়। যেমন, বন্যা বিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ দুর্যোগ হলেও, অনেক বন্যাপ্রবণ দেশে জলবায়ু নিয়ে উদ্বেগ তুলনামূলক কম। তবে কি মানুষ ঠেকেও শিখতে চাইছে না?

গবেষকরা বলছেন, এর অন্যতম কারণ হতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট উপস্থাপনের ধরণ।যদি নেতারা ও সাংবাদিকরা দুর্যোগকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করে ব্যাখ্যা দেন, তাহলে মানুষ দ্রুত বাস্তবতা বোঝে; কিন্তু যদি তা নিয়ে একেবারেই চর্চা না হয়, তবে হাজার বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয় না।

দেখা গেছে, দক্ষিণ আমেরিকায় প্রায় ৭৫% মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনকে অত্যন্ত গুরুতর বলে মনে করেন। যেই মাত্রা এখনো অবধি বিশ্বের নিরিখে সর্বোচ্চ। ইউরোপে সেই হার প্রায় অর্ধেক। ওশিয়ানিয়ার প্রায় ৪০% মানুষ গত পাঁচ বছরে অন্তত একবার চরম আবহাওয়ার শিকার হয়েছেন, অথচ ইউরোপে এই সংখ্যা মাত্র ২০%।

আসলে যেখানে অভিজ্ঞতা আর উদ্বেগ একসাথে বেশি, সেখানে পরিবর্তনের পথ সহজ। কিন্তু যেখানে অভিজ্ঞতা আছে অথচ উদ্বেগ কম, সেখানে নেতৃত্বের কাজ আরও কঠিন।

এই গবেষণাটির সবচেয়ে বড় বার্তা হলো—চরম আবহাওয়া মানুষকে সচেতন করে তোলে ঠিকই, কিন্তু শুধু ভয়ই যথেষ্ট নয়। সমাজ, সরকার ও গণমাধ্যমকে সেই অভিজ্ঞতাকে নীতিগত পরিবর্তনের ভাষায় রূপ দিতে হবে।

গবেষক ডাবল্যান্ডার বলেন,মানুষ যত বেশি জলবায়ুর কোপে পড়ে, তত বেশি তারা পরিবর্তন চায়। কিন্তু যদি নেতারা ও গণমাধ্যম এগিয়ে না আসে, তাহলে সেই অভিজ্ঞতাও একদিন না একদিন নিঃশব্দে মিলিয়ে যায়।

অর্থাৎ, প্রকৃতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে নিজের অসুস্থতাকে তুলে ধরছে, কিন্তু আমরাই পারছি না সেই দেখা থেকে শিক্ষা নিতে। বিপর্যয় মানুষকে জাগিয়ে তোলে, কিন্তু সেই জাগরণকে কর্মে রূপ দিতে হবে সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বদেরই।

 

 

সূত্র Climate hazard experience linked to increased climate risk perception worldwide by Fabian Dablander, published in the journal Environmental Research Letters,(7.10.2025).

DOI 10.1088/1748-9326/ae0ae9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − 12 =