কৃ বু-র জাদুতে অন্ধের গ্রন্থপাঠ

কৃ বু-র জাদুতে অন্ধের গ্রন্থপাঠ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ নভেম্বর, ২০২৫

সম্প্রতি এক যুগান্তকারী গবেষণায় দেখা গেছে, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন বা মধ্যদৃষ্টিক্ষেত্র হারানো মানুষও আবার বই পড়তে, লেখা চিনতে এবং মুখ শনাক্ত করতে পারছেন। সবটাই সম্ভব হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (কৃ বু) চালিত এক ক্ষুদ্র চিপের মাধ্যমে। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভুগছেন এক অবক্ষয়জনিত চোখের রোগে যার নাম ড্রাই এজ-রিলেটেড ম্যাকুলার ডিজেনারেশন । এই রোগে চোখের রেটিনার মাঝের অংশটি ক্ষয়ে যায়, ফলে ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। মুখ চিনে ওঠা, পড়া বা সূক্ষ্ম কাজ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত এই রোগের কার্যকর চিকিৎসা নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এবার এক নতুন পথ খুলেছেন – প্রযুক্তি ও কৃত্রিম সংকেতের মাধ্যমে চোখের দৃষ্টি ফিরে আসে। এই গবেষণায় ৫টি দেশের ১৭টি চিকিৎসা কেন্দ্রে ৩৮ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রত্যেকেরই উভয় চোখের কেন্দ্রীয় দৃষ্টিক্ষেত্র সম্পূর্ণ অকার্যকর ছিল। গবেষক দল প্রতিটি রোগীর চোখে স্থাপন করেন ‘প্রাইমা ’ নামের মাত্র ২ মিলিমিটার প্রশস্ত এক ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক চিপ, যার আকার একটি সিম কার্ডের থেকেও ছোট। অস্ত্রোপচার করে এই চিপটিকে রেটিনার নীচে বসানো হয়। অস্ত্রোপচারের কয়েক সপ্তাহ পর চিপটি চালু করা হয় এবং রোগীকে দেওয়া হয় একটি স্মার্ট চশমা। তার সামনের অংশে একটি ক্ষুদ্র ক্যামেরা থাকে। চশমাটির ক্যামেরা যে দৃশ্য দেখে, সেটি সংলগ্ন একটি ছোট কম্পিউটারে পাঠানো হয়। এই কম্পিউটার কৃ বু ব্যবহার করে ছবিকে অবলোহিত সংকেতে রূপান্তর করে, যা সরাসরি চোখের ভিতরে বসানো চিপে পৌঁছে যায়। চিপ সেই সংকেত পাঠায় মস্তিষ্কে। আর মস্তিষ্ক সেটিকে দৃষ্টির অনুভূতি হিসেবে ব্যাখ্যা করতে শেখে। এক কথায়, চোখ না থাকলেও দেখা সম্ভব হচ্ছে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চোখ দিয়ে। ফলাফল অবিশ্বাস্য। ৩৮ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৮৪ শতাংশ রোগী আবার পড়তে সক্ষম হয়েছেন। অস্ত্রোপচারের আগে এটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। গড় হিসেবে তাঁরা দৃষ্টি পরীক্ষার চার্টের পাঁচটি লাইন পর্যন্ত পড়তে পেরেছেন। যদিও এই দৃষ্টি পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়, তবুও এটি তাদের জীবনে নতুন আলো এনেছে।

একজন রোগী জানান, “অপারেশনের আগে আমি চোখে শুধু দুটি কালো কালো ছায়া দেখতাম। বই পড়া ছিল অসম্ভব। কিন্তু এখন আমি লেখা শব্দ চিনতে পারছি, ধীরে ধীরে বাক্যও পড়তে পারছি। এ যেন আমার নতুন জন্ম।“তিনি এখন ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধান করেন, ওষুধের লেবেল পড়েন এবং এমনকি খাবারের কৌটোর গায়ের ছোট ছোট লেখাও পড়তে পারছেন। বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলেছেন, এই প্রযুক্তির উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া নয়, কিন্তু হারানো কেন্দ্রীয় দৃষ্টিক্ষেত্রর এক ‘বিকল্প’ রূপ ফিরিয়ে দেওয়া। কারণ এ রোগে অনেক রোগীর পার্শ্ববর্তী দৃষ্টি সক্রিয় থাকে। তার সাহায্যে তারা চলাফেরা বা বাধা শনাক্ত করতে পারেন। এই নতুন চিপ সেই অংশে হস্তক্ষেপ করে না; কেবল কেন্দ্রীয় অন্ধ অংশটিকেই সক্রিয় করে। চক্ষু গবেষক ড. মাহী মুকিত বলেছেন, “এ কৃত্রিম দৃষ্টির ইতিহাসে এক বিপ্লব। এই প্রথম আমরা এমন সব রোগীদের কার্যকর কেন্দ্রীয় দৃষ্টি দিতে পেরেছি, যারা সম্পূর্ণ অন্ধ।“এই প্রযুক্তি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এর বাণিজ্যিক সংস্করণ বাজারে আসতে বেশি দেরি নেই। চিপ বসানোর অস্ত্রোপচারে দু’ঘণ্টারও কম সময় লাগে। ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। যদি অনুমোদন পাওয়া যায়, তাহলে এটি ড্রাই এএমডি রোগীদের জন্য এক নতুন আশার দিগন্ত খুলে দিতে পারে। গবেষণাটি কেবল প্রযুক্তিগত নয়, মানবিক অর্থেও এক আশ্চর্য কাহিনী। দৃষ্টিহীনদের কাছে ‘পড়া’ মানে তো কেবল অক্ষর চিনে নেওয়া নয়, আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতা ও মর্যাদা ফিরে পাওয়া।

 

সূত্র : Subretinal Photovoltaic Implant to Restore Vision in Geographic Atrophy Due to AMD

Authors: Frank G. Holz, M.D., Yannick Le Mer, et.el; Published October 20, 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 + 2 =