নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে শক্তিশালী করে, মনকে উৎফুল্ল রাখে, হৃদ্যন্ত্র ও পেশিকে সক্রিয় রাখে। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন ব্যায়াম কেবল শরীরের বাহ্যিক পরিবর্তনই আনে না, একেবারে আণবিক স্তরে গিয়ে জিন, প্রোটিন ও কোষ প্রক্রিয়াকে পুনর্গঠন করে দেয়। এটি শরীরের ভেতরের জৈব নেটওয়ার্ককে নতুনভাবে সাজিয়ে ফেলে প্রাকৃতিক ওষুধের মতো কাজ করে।
গবেষণাটি করেছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি (এ সি ইউ)–র দুই বিজ্ঞানী প্রফেসর জন হাওলে ও ড. নোলান হফম্যান। এটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার রিভিউ এন্ডোক্রিনোলজি পত্রিকায়। তারা গত ২০ বছরের মানব ব্যায়াম-জৈবরসায়ন সংক্রান্ত গবেষণার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন ব্যায়াম কীভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কোষ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
প্রফেসর হাওলে বলেন, “ব্যায়াম কেবল শারীরিক সক্ষমতার বিষয় নয়, এটি এক শক্তিশালী জৈব চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি শরীরের গভীরতম আণবিক স্তরে গিয়ে পরিবর্তন আনে।” তাঁর মতে, হৃদরোগ, স্থূলতা বা টাইপ–২ ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যায়াম একদিন প্রতিরোধী ওষুধের মতো ব্যবহৃত হতে পারে।
ড. হফম্যান বলেন, “২০ বছর আগেও আমরা জানতাম ব্যায়াম করা শরীরের পক্ষে ভালো, কিন্তু ঠিক কেন ভালো তা জানতাম না।”
সাম্প্রতিক আণবিক জীববিজ্ঞান ও ওমিক্স-প্রযুক্তির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা এখন জানেন, ব্যায়ামের সময় হাজার হাজার অণু ও প্রোটিন সক্রিয় হয়, এবং এই জটিল নেটওয়ার্কই শরীরের বিপাকক্রিয়া, রোগ প্রতিরোধ ও কোষ পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে চালিত করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যায়াম শরীরে এক ধরনের জৈব ঐকতান তৈরি করে। সেখানে প্রতিটি কোষ একই তালে ছন্দ মিলিয়ে কাজ করে।এটি পেশির জিন ও প্রোটিনকে সক্রিয় করে, রক্তপ্রবাহে রাসায়নিক বার্তা পাঠায়, এমনকি কোষ থেকে জৈব-অণুসমষ্টি নিঃসৃত হয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। এর ফলে ব্যায়ামের প্রভাব শুধু পেশিতে নয়, সমগ্র শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে – রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের স্নায়ু সংযোগ পর্যন্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে ব্যায়াম জিনের সক্রিয়তা ও প্রোটিন তৈরির সময়সূচী পরিবর্তন করে। এটি রক্তে থাকা রোগ প্রতিরোধতন্ত্র ও বিপাকীয় পথগুলোকেও নতুনভাবে সংগঠিত করে।
এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, এটি শরীরকে শেখায় কীভাবে অসুখ প্রতিরোধ করতে হয়, শুধুই প্রতিক্রিয়া নয় – পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন ভবিষ্যতে এই আণবিক সূচক ব্যবহার করে তৈরি করা যাবে একক ব্যক্তিনির্ভর শারীরিক অনুশীলনভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এ এমনই এক আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির শারীরিক গঠন, জিনগত বৈশিষ্ট্য, বয়স, রোগের ধরন, জীবনযাপন ও বিপাকীয় হার বিবেচনা করে বিশেষভাবে তার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম সূচি নির্ধারণ করা হয় , যেমনটি ব্যক্তিগতভাবে ওষুধ নির্ধারণের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
এ সি ইউ–এর মেলবোর্ন ক্যাম্পাসে তৈরি হয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধের একমাত্র “হিউম্যান মেটাবলিক চেম্বার”, যেখানে মানুষের শক্তি ব্যয়, বিপাক ও আণবিক প্রতিক্রিয়া একদম সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা হয়, যাতে ব্যায়ামের প্রভাবকে একেবারে অণু -পরমাণু স্তর পর্যন্ত অনুসন্ধান করা যায়।
মোটকথা, ব্যায়াম শুধুমাত্র শরীরচর্চা নয়, এটি ভবিষ্যতের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক দৃষ্টান্তমূলক দিকনির্দেশনা। সেখানে ওষুধকে ছাপিয়ে ব্যায়ামই হবে এক শক্তিশালী, দীর্ঘায়ু ও রোগমুক্ত ভবিষ্যতের যথাযথ ঠিকানা।
সূত্র : “Twenty years of progress in human exercise metabolism research” by John A. Hawley and Nolan J. Hoffman, (9.0.92025), Nature Reviews Endocrinology.
DOI: 10.1038/s41574-025-01181-1
