মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক ও নদী দূষণ  

মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক ও নদী দূষণ  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২ নভেম্বর, ২০২৫

ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নতুন এক বৈশ্বিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানুষের ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের বেশির ভাগ শেষ পর্যন্ত নদী-নালায় গিয়ে মিশছে। স্বভাবতই নদী বহুলাংশে দূষিত হচ্ছে। এই অদৃশ্য দূষণ জলজ প্রাণীর জীবনের জন্য হুমকি তো বটেই, উপরন্তু বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার ঘটানোর আশঙ্কাও বাড়াচ্ছে। ফলে মানবজাতির ভবিষ্যতও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন, প্রতি বছর প্রায় ৮,৫০০ টন অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীর থেকে নির্গত হয়ে বর্জ্যজল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র অতিক্রম করে শেষমেশ নদীগুলিতে প্রবেশ করছে। অর্থাৎ, পৃথিবীতে ব্যবহৃত মোট অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই শেষ পর্যন্ত নদী প্রণালীতে চলে যাচ্ছে। এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে পি এন এ এস নেক্সাস জার্নালে। এটি মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে নদী দূষণের প্রথম বৈশ্বিক মূল্যায়ন হিসেবে বিবেচিত।

গবেষণার প্রধান লেখক ড. হেলোইসা এহাল্ট মাচেডোর মতে, নদীর জলে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি অনেক সময় এত কম যে মাপা যায় না, তবুও দীর্ঘমেয়াদে ধারাবাহিকভাবে সংস্পর্শে থাকা এসব রাসায়নিক মানবস্বাস্থ্য ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য দারুণ বিপজ্জনক হতে পারে।

প্রায় ৯০০টি নদীর বাস্তব তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এক বৈশ্বিক মডেল তৈরি করেছেন। এতে দেখা গেছে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক অ্যামোক্সিসিলিন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদীগুলোতে। কারণ, এই অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, অথচ বর্জ্যজল শোধনের ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত।

সহ-গবেষক প্রফেসর বার্নহার্ড লেহনার বলেন, “আমরা একেবারেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিরোধিতা করছি না, কারণ এগুলো চিকিৎসায় অপরিহার্য। তবে অজান্তে এগুলোর পরিবেশগত প্রভাব বিস্তার কমাতে কার্যকর ব্যবস্থাপনা জরুরি।”

আরেক সহ-লেখক, পরিবেশ প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ জিম নিসেল, বলেন, এই গবেষণায় গবাদি পশুখামার বা ওষুধ তৈরির কারখানা থেকে আসা অ্যান্টিবায়োটিকের হিসাব অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি, যদিও দূষণের মূলে এই দুটি উৎসেরও অবদান অনেক। শুধুমাত্র মানুষের ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকেই এই বেহাল অবস্থা । আর যদি এই দুই উৎসের অবদানও ধরা হয় তাহলে চিত্রটা আরও বিভীষিকাময় হয়ে উঠবে।

গবেষকরা জোর দিয়ে সতর্ক করেছেন, এই “অদৃশ্য ওষুধ দূষণ” কিন্তু এখন আস্তে আস্তে বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়, জলাশয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য রাসায়নিক দূষণের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অবিলম্বে কর্মসূচি শুরু করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই অদৃশ্য মানব ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই দূষণ ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

 

আজ নদীর জলে যে ওষুধ জমছে, কাল সেটিই হয়তো আমাদের দেহে ফিরে আসবে খাদ্য, জল আর জীবনের প্রতিটি স্তরে। তাই সময় থাকতে থাকতে প্রকৃতির এই অবধারিত আসন্ন সংকটকে অবহেলা না করে তাকে মোকাবিলা করা প্রয়োজন।

 

সূত্র: “Antibiotics in the global river system arising from human consumption” by Heloisa Ehalt Macedo, Bernhard Lehner, et.al; (22.04.2025), PNAS Nexus.

DOI: 10.1093/pnasnexus/pgaf096

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − eleven =