আজগুবি নয়, সত্যিকারের ব্যথা

আজগুবি নয়, সত্যিকারের ব্যথা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৬ নভেম্বর, ২০২৫

বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য মানুষ ভুগছেন দীর্ঘস্থায়ী অবসাদজনিত ক্রনিক ফেটিগ সিন্ড্রোম/ সি এফ এস কিংবা পেশির ব্যথাজনিত মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের প্রদাহ (মায়ালজিক এনসেফালোমাইলাইটিস /এম ই) নামক অদ্ভুত অসুখে। অদ্ভুত এ কারণে যে, প্রচণ্ড ক্লান্তি, দুর্বলতা, ব্যথা, অনিদ্রা, আর অবসাদে ভুগে রোগীদের জীবন একপ্রকার দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও, পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়ত না। ফলে চিকিৎসকরা কোনো কূল-কিনারা করতে না পেরে অনেক সময় বলতেন এটা নাকি মানসিক সমস্যা, সবটাই মনের সমস্যা। কিন্ত অবশেষে ব্রিটেনের ইস্ট অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বায়োডাইনামিক্সের বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন এক অভূতপূর্ব রক্তপরীক্ষা, যা ৯৬% নির্ভুলতায় এই রোগ শনাক্ত করতে পারে। এই আবিষ্কারটিকে একবিংশ শতাব্দীর নতুন বৈজ্ঞানিক বিস্ময় বললেও ভুল হবে না।

এই রক্তপরীক্ষাটি তৈরি হয়েছে উন্নত এপিসুইচ 3® ডি জিনোমিক্স প্রযুক্তি (এআইএম: ওবিডি) ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ৪৭ জন গুরুতর এম ই/সি এফ এস রোগী এবং ৬১ জন সুস্থ ব্যক্তির রক্তে উপস্থিত ডি এন এ-র ভাঁজের ত্রিমাত্রিক গঠন বিশ্লেষণ করেন।

আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে প্রায় দুই মিটার লম্বা ডি এন এ থাকে, যা নিখুঁত ত্রি-মাত্রিক কাঠামোয় ভাঁজ খেয়ে জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। এই ভাঁজের ধরনই নিয়ন্ত্রণ করে কোন জিন সক্রিয় থাকবে আর কোনটি থাকবে না।

গবেষণায় এম ই/সি এফ এস আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডি এন এ-তে একটি অনন্য ভাঁজের ধরণ দেখা গেছে, যা সুস্থ মানুষের দেহে পাওয়া যায় না।এই সূক্ষ্ম পার্থক্যই বিজ্ঞানীদের হাতে এনে দিয়েছে উচ্চমাত্রার নির্ভুলতা। তা ৯২% সংবেদনশীলতার সাথে নির্দেশ করে কারা সত্যিই অসুস্থ এবং ৯৮% নির্দিষ্টতা নিয়ে জানায় কারা অসুস্থ নন -তাদের বাদ দেওয়া হয়।

ইউ ই এ-এর অধ্যাপক দিমিত্রি পসেজেতস্কি বলেন, এম ই / সি এফ এস কোনো কাল্পনিক অসুস্থতা নয়। এটি এক বাস্তব জৈবিক সমস্যা, যা দেহের শক্তি উৎপাদন ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়। আমাদের শরীরের জিনের ভাঁজে এর ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

তিনি আরও বলেন, এই রোগের বহু রোগী বছরের পর বছর ভুল রোগনির্ণয়, অবহেলা ও সামাজিক কলঙ্কবোধের শিকার হয়েছেন। তাদের কষ্ট যে নিছকই আবোলতাবোল মাথার ব্যামো নয় বিজ্ঞান তা আজ স্বীকার করছে। এখন এই রক্তপরীক্ষা তাদের জন্য দ্রুত, সহজ এবং নির্ভুল সমাধান এনে দিতে পারে।

গবেষকেরা বলছেন, এই পরীক্ষার পদ্ধতি ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী কোভিড পরবর্তী জটিলতা শনাক্ত করতেও ব্যবহার করা যাবে। কারণ দুই অসুখের উপসর্গ ও জৈবিক প্রভাব প্রায় একই। যেমন, দীর্ঘ ক্লান্তি, মস্তিষ্কে ঝাপসা ভাব, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি।

অক্সফোর্ড বায়োডায়নামিক্স-এর বিজ্ঞানী আলেক্সান্দ্রে আকুলিচেভ বলেছেন, এই রোগ বংশগত নয়, এটি জীবদ্দশাতেই ডি এন এ-তে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের পরিণাম। এই ‘ত্রিমাত্রিক জিনোম’ পরীক্ষা বহু বছর ধরে উপেক্ষিত রোগীদের জন্য এক আশার আলো।

গবেষকেরা আশা করছেন, এই পরীক্ষাটি ভবিষ্যতে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সহজলভ্য হবে। এর মাধ্যমে শুধু সঠিক রোগ নির্ণয়ই নয়, রোগীর শরীরের কোন অংশে সমস্যা বেশি, কোন ওষুধ সবচেয়ে কার্যকর তাও স্পষ্ট বোঝা যাবে।

 

সূত্র: “Development and validation of blood-based diagnostic biomarkers for Myalgic Encephalomyelitis/Chronic Fatigue Syndrome (ME/CFS) using EpiSwitch® 3-dimensional genomic regulatory immuno-genetic profiling” by Ewan Hunter, Heba Alshaker,et.al; (8.10.2025), Journal of Translational Medicine.

DOI: 10.1186/s12967-025-07203-w

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + seven =