সূর্যের গোপন ঘূর্ণিতরঙ্গের সন্ধান

সূর্যের গোপন ঘূর্ণিতরঙ্গের সন্ধান

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৮ নভেম্বর, ২০২৫

সূর্যের রহস্যময় শক্তি আজও বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে। সূর্যের বাইরের মণ্ডল বা করোনা প্রচন্ড উত্তপ্ত, অথচ তার দৃশ্যমন্ডল বা ফটোস্ফিয়ার তুলনামূলকভাবে অনেক ঠান্ডা। করোনার তাপমাত্রা যেখানে কয়েক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যায়, সেখানে সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র প্রায় ৫,৫০০ ডিগ্রি। এই অস্বাভাবিক বৈষম্যের কারণ খুঁজতে প্রায় আট দশক ধরে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এতদিনে সেই দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষ হলো এক অসাধারণ সাফল্যের মাধ্যমে। গবেষকরা এই প্রথম সূর্যের উপরে এমন এক ক্ষুদ্র, ঘূর্ণায়মান চৌম্বক তরঙ্গ শনাক্ত করেছেন যা সূর্যের করোনায় শক্তি পরিবহনের মূল চাবিকাঠি হতে পারে। এই তরঙ্গগুলিকে বলা হয় টর্শানাল আলভেন তরঙ্গ। ১৯৪২ সালে সুইডিশ পদার্থবিদ হানেস আলভেন প্রথম এই ধরণের চৌম্বক তরঙ্গের অস্তিত্বের ধারণা দিয়েছিলেন। তখন এটি শুধু তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ ছিল। আজ প্রায় ৮০ বছর পর আধুনিক প্রযুক্তি সেই তত্ত্বই বাস্তবে প্রমাণ করল। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সূর্য পর্যবেক্ষণ যন্ত্র ‘ড্যানিয়েল কে. ইনোয়ে সোলার টেলিস্কোপ’-এর সাহায্যে এই আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। এটি হাওয়াই দ্বীপের হালেয়াকালা পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত। এর চার মিটার ব্যাসের আয়না, সূক্ষ্মতম সৌর ঘটনাও ধরতে সক্ষম। গবেষক দলটি টেলিস্কোপের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে সূর্যের করোনা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান, সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের রেখাগুলি ক্ষুদ্র ঘূর্ণন সৃষ্টি করছে। যেন এক অদৃশ্য শক্তি সূর্যের গায়ে পাক খাচ্ছে। এই ঘূর্ণনটাই আসলে টর্শানাল আলভেন তরঙ্গ। এ গবেষণার নেতৃত্ব দেন ব্রিটেনের নর্দামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ রিচার্ড মর্টন। তিনি বলেছেন,“সূর্যের প্লাজমা সাধারণত দোলায়মান থাকায় এই ঘূর্ণায়মান তরঙ্গগুলিকে শনাক্ত করা এতদিন প্রায় অসম্ভব ছিল।“ মর্টনের দল এক বিশেষ বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে সেই দোলনগতি বাদ দিয়ে ঘূর্ণনধর্মী সংকেতকে আলাদা করতে সক্ষম হন। সূর্য থেকে আসা আলোর বর্ণালী সংকেত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একদিকে প্লাজমা পৃথিবীর দিকে এগোচ্ছে ( নীল অপসরণ গতি), অন্যদিকে দূরে সরে যাচ্ছে ( লাল অপসরণ গতি)। এই দুই বিপরীতমুখী গতির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সূর্যের সেই বহু প্রতীক্ষিত ঘূর্ণন তরঙ্গ। এই তরঙ্গগুলিই সূর্যের করোনা এত গরম থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে। সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের রেখাগুলির মধ্য দিয়ে এই তরঙ্গগুলি শক্তি বহন করে উপরে উঠে এসে তাকে প্লাজমায় ছড়িয়ে দেয়। ফলে করোনা গরম থাকে। এছাড়া, এই তরঙ্গগুলি সূর্য থেকে নির্গত চার্জযুক্ত কণাপ্রবাহ, অর্থাৎ সৌরবায়ুরও উৎস হতে পারে। এই সৌরবায়ু পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ও কৃত্রিম উপগ্রহের যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলে। তাই এই গবেষণা শুধু সূর্য নয়, পুরো সৌরজগতের গতিবিধি বোঝার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ।

 

সূত্র: “Evidence for small-scale torsional Alfvén waves in the solar corona” by R. J. Morton, Y. Gao, E. Tajfirouze, H. Tian, T. Van Doorsselaere and T. A. Schad, 24 October 2025, Nature Astronomy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four + 14 =