সম্ভাব্যতাই বিজ্ঞানের দিশারি

সম্ভাব্যতাই বিজ্ঞানের দিশারি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৮ নভেম্বর, ২০২৫

বিজ্ঞান অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে সত্যের সন্ধান করে। আর সেই অনিশ্চয়তাকে বোঝার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো সম্ভাব্যতা। কিন্তু এই সম্ভাব্যতা কোনো বস্তুগত জিনিস নয়। বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। এ মানুষের তৈরি এক বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষা, যা অসম্পূর্ণ তথ্যকে বোঝার এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর উপায় তৈরি করে দেয়।

এ এমন এক গাণিতিক ভাষা, যা আমাদের অসম্পূর্ণ তথ্যকে বোঝার ও ব্যবহারের উপায় বাতলে দেয়। যখন আবহাওয়াবিদ বলেন আজ ৬০% বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে, বা চিকিৎসকরা জানান এই ওষুধ মৃত্যুহার ১৭% কমায়, তাঁরা কিন্তু প্রকৃত ভবিষ্যৎ না জেনেই সেকথা বলেন। তাঁরা কেবল প্রমাণ, পরিসংখ্যান ও যুক্তির ভিত্তিতে সম্ভাব্য ফলাফল অনুমান করেন। এইভাবেই বিজ্ঞানে, চিকিৎসায় এবং আমাদের প্রতিদিনের জীবনে পথ দেখায় সম্ভাব্যতা।

এই সম্ভাব্যতা বোঝার দুটি সনাতন উপায় আছে, বা বলা চলে সম্ভাব্যতার দুটি মূল দৃষ্টিভঙ্গি আছে। একটা ঘটনা কতবার ঘটে সেই দৃষ্টিভঙ্গি ধরে, কোনো ঘটনার সম্ভাব্যতা হলো বহুবার পুনরাবৃত্তির পর তার গড় মান। যেমন, অসংখ্যবার মুদ্রা টস করার পর প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে হেড আসবে। অন্যদিকে, বেইজিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভাব্যতাকে বিশ্বাসের মাত্রা হিসেবে দেখে বর্তমান তথ্য অনুযায়ী কোনো ঘটনার ঘটার সম্ভাব্যতা কতটা তা নির্ধারণ করে। বাস্তব বিজ্ঞানে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি একে অপরের পরিপূরক। বিজ্ঞান এই দুই ভাষায়ই কথা বলে। কখনো বারবার ঘটা ঘটনার গড় দেখে, কখনো একবারের সিদ্ধান্তে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।

বৈজ্ঞানিক মডেলগুলো বাস্তবতার সরলীকৃত সংস্করণ। এর উদ্দেশ্য বাস্তব জগৎকে হুবহু অনুকরণ করা নয়। এর উদ্দেশ্য হল, নির্দিষ্ট প্রশ্নের প্রাসঙ্গিক দিকগুলো আলাদা করে স্পষ্টভাবে বোঝানো। যদি কোনো মডেলের অনুমান তথ্যের সঙ্গে না মেলে, বিজ্ঞানীরা সেটি সংশোধন করেন।

কোভিড-১৯ মহামারির সময় সম্ভাবনার ব্যবহার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যুক্তরাজ্যের আরোগ্য গবেষণা থেকে দেখা যায়, ডেক্সামেথাসোন নামক স্টেরয়েড গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মৃত্যুহার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমায়। এখানে সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করা হয়েছিল র‌্যান্ডমাইজড ট্রায়ালের মাধ্যমে। অর্থাৎ রোগীদের এলোমেলোভাবে ভাগ করে ফলাফল যাচাই করা হয়। এই তথ্যই চিকিৎসকদের পরবর্তী সিদ্ধান্তে দিকনির্দেশনা দেয়।

তবে সম্ভাব্যতা কোনো চূড়ান্ত সত্য নয়। নতুন তথ্য এলে সম্ভাব্যতা পরিবর্তিত হয়। বিজ্ঞানের শক্তি এখানেই। বিজ্ঞান অনিশ্চয়তাকে স্বীকার করে, কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠ পদ্ধতিতে সেই অনিশ্চয়তার মোকাবিলাও করে। পুরনো তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত বদলান, যা বিজ্ঞানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। এখানেই বিজ্ঞানের সততা।

আজ চিকিৎসা, জলবায়ু বিজ্ঞান, প্রকৌশল থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত,সব ক্ষেত্রেই সম্ভাব্যতা আমাদের সঙ্গী। সঙ্গে ছাতা নেওয়া, পরীক্ষা দেওয়া, বা ঝুঁকি মূল্যায়ন—সবক্ষেত্রেই আমরা অবচেতনে এই ভাষায় চিন্তা করি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্ভাব্যতা আমাদের যুক্তিনিষ্ঠ সিদ্ধান্তে সাহায্য করে।

মোটকথা ,সম্ভাব্যতা হলো অনিশ্চয়তাকে বোঝার ভাষা। এটি কোনো বাস্তব উপাদান নয়, বরং এক বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো যা অসম্পূর্ণ তথ্যকে কার্যকর জ্ঞানে পরিণত করে। এটি আমাদের শেখায় কিভাবে অনিশ্চয়তার মাঝেও যুক্তি, প্রমাণ আর সাহস নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আর সেখানেই বিজ্ঞানের আসল সৌন্দর্য।

 

সূত্র : Why probability probably doesn’t exist (but it is useful to act like it does) by David Spiegelhalter, published in the journal Nature,(29.10.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − ten =