অস্থির অভিবাসী নিয়ান্ডারথাল  

অস্থির অভিবাসী নিয়ান্ডারথাল  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৯ নভেম্বর, ২০২৫

কখনও কখনও খুব ছোট্ট প্রমাণেও ইতিহাসের গল্পটা ওলটপালট হয়ে যায়। যেমন ক্রিমিয়ার স্টারোসেলে গুহায় পাওয়া মাত্র দুই ইঞ্চি লম্বা একখানা হাড়ের টুকরো, যার নাম -“স্টার ১”। এটি বদলে দিয়েছে নিয়ান্ডারথালদের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ধারণা। তারা শুধু এক জায়গায় বাস করত না, তারা ছড়িয়ে ছিল সমগ্র ইউরেশিয়া জুড়ে। তারা এক অদম্য অভিবাসনশীল জাতি।

অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা আধুনিক আণবিক প্রযুক্তি ও প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ ব্যবহার করে আবিষ্কার করেছেন যে এই হাড়টি ছিল প্রায় ৪৫,০০০ বছর আগে জীবিত এক কিশোর নিয়ান্ডারথালের। সে যুগে ইউরোপ বরফে ঢাকা ছিল, আর মানুষ তখনও প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকার পথ খুঁজে নিচ্ছিল।

প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন স্টারোসেলে গুহায় পাওয়া হাড়গুলো নিছক মধ্যযুগীয় কবর। কিন্তু জু এম এস (জুও আর্কিওলজি বাই মাস স্পেকটোমেট্রি) প্রযুক্তিতে ১৫০টি হাড় পরীক্ষা করতে গিয়ে এক আশ্চর্য আবিষ্কার ঘটে। অধিকাংশ হাড়ই ঘোড়া ও হরিণের, কিন্তু একটি হাড়ের কোলাজেন প্রোটিন মিলল মানুষের পরিবারের সঙ্গে। মাইক্রো-সিটি স্ক্যান ও রেডিওকার্বন ডেটিং জানাল এটি নিয়ান্ডারথালের উরুর অংশ, এর বয়স প্রায় ৪৬,০০০ বছর।

তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল এর জিন ঘটিত সংযোগ। এই হাড়ের ডিএনএ মিলে গেছে সাইবেরিয়ার আলতাই অঞ্চলের নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে, যা ক্রিমিয়া থেকে প্রায় ৩,০০০ কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ, এই প্রাচীন মানুষরা শুধু গুহায় বাস করত না, তারা তৃণভূমি পেরিয়ে, পর্বত অতিক্রম করে, হাজার হাজার মাইল দূর পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিল।

স্টারোসেলের পাথরের সরঞ্জামগুলিও এই সংযোগের ইঙ্গিত দেয়। এগুলো “ক্রিমিয়ান মাইকোকুইয়ান ঐতিহ্য”র অন্তর্গত, যা দ্বিমুখী ধারালো যন্ত্র তৈরির নিখুঁত কৌশলের জন্য পরিচিত। একই রকম সরঞ্জাম আলতাই অঞ্চলের চাগিরস্কায়া ও ওকলাদনিকভ গুহায় পাওয়া গেছে। এ থেকে কৃষ্টিগত যোগাযোগ বা অভিন্ন শিকড়ের ইঙ্গিত মেলে।

হাড়ের বিশ্লেষণে জানা যায়, স্টারোসেলে ছিল বরফযুগের কঠোর পরিবেশে এক টিকে থাকার কেন্দ্র। ঘোড়া ছিল প্রধান খাদ্য, পাশাপাশি হরিণ, বাইসন ও ম্যামথও শিকার করা হতো। প্রায় ৯৭% নমুনা থেকে স্পষ্ট উপাত্ত পাওয়া গেছে, যা সেই সময়কার জীববৈচিত্র্য ও মানবজীবনের একটি স্পষ্ট ছবি দেয়।

আবহাওয়ার মডেল অনুযায়ী, নিয়ান্ডারথালদের এই চলাচল সম্ভব হয়েছিল দুইটি উষ্ণ ও আর্দ্র সময়কালে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার ও ষাট হাজার বছর আগে। তখন ইউরোপ থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত ছিল খোলা তৃণভূমির সংযোগ পথ। এই প্রাকৃতিক পথই হয়তো তাদের অভিবাসনের রাস্তা ছিল।

 

আজ এই ক্ষুদ্র হাড়ের টুকরো প্রমাণ করেছে ক্রিমিয়া ছিল শুধু পৃথিবীর এক প্রান্ত নয়, বস্তুত নিয়ান্ডারথালদের কৃষ্টিকেন্দ্র। এখান থেকে তারা সংযুক্ত ছিল সাইবেরিয়া, ইউরোপ ও কৃষ্ণসাগরের উপত্যকার সঙ্গে। প্রাচীন মানুষরা কখনও স্থির ছিল না। তারা চলেছিল, অভিযোজিত হয়েছিল, জ্ঞান ও কৌশল বহন করেছিল হাজার মাইল জুড়ে। স্টার ১-এর কাহিনী আসলে মানবজাতির প্রথম যাত্রার গল্প। সেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল টিকে থাকার, শেখার, আর পৃথিবীকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার এক সাহসী প্রয়াস।

 

সূত্র : A new late Neanderthal from Crimea reveals long-distance connections across Eurasia by Emily M. Pigott, Konstantina Cheshmedzhieva,et.al; published in the journal Proceedings of the National Academy of Sciences,(27.10.2025).

https://doi.org/10.1073/pnas.2518974122

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × three =