উত্তর মেরুর বরফ ঢাকা সমুদ্রে, নীরবে সাঁতারে বেড়ায় পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত আশ্চর্য— বো হেড তিমি। বিশালাকারের এই তিমি পৃথিবীর শুধু সবচেয়ে দীর্ঘজীবী স্তন্যপায়ী প্রাণীই নয়, জৈববিজ্ঞানের এক উত্তরহীন রহস্যও বটে। কারণ, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এই প্রাণী প্রায় দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঁচতে পারে! গবেষকরা জানাচ্ছেন, বো হেড তিমির দীর্ঘায়ুর মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে তাদের কোষের ভিতরে। বিশেষত এক ধরনের প্রোটিন দক্ষতা, যা কোষকে “বুড়ো” হতে দেয় না। সাধারণভাবে মনে করা হয়, যত বড় দেহ, তত বেশি কোষ, আর যত বেশি কোষ, ক্যানসারের আশঙ্কাও তত বেশি। কিন্তু এই তিমি সেই ধারণাকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে। প্রায় ৭০–৮০ টন ওজনের তিমি খুব কমই কোষবিকৃতি বা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এই বৈপরীত্যকেই বলে পিটো প্যারাডক্স। অর্থাৎ, বড় দেহ মানেই বেশি রোগ নয়। এই তিমির দেহে দেখা গেছে এক চমকপ্রদ বিষয়। তারা কোষকে মেরে ফেলে না, বরং নিজে নিজেকেই মেরামত করে। তাদের দেহে এমন এক জৈবপ্রক্রিয়া সক্রিয়, যা কোষের ক্ষয়, ভাঙন বা বার্ধক্যকে সময়মতো মেরামত করে ফেলতে পারে। গবেষকরা দীর্ঘ অনুসন্ধানে খুঁজে পেয়েছেন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন। সি-আই-আর-বি-পি (CIRBP)-“ঠান্ডায় উদ্দীপিত আরএনএ-আবদ্ধ প্রোটিন”। এই তিমির কোষে এমন প্রোটিনের ঘনত্ব অস্বাভাবিক বেশি। প্রোটিনটির কাজ হল, কোষে চাপ বা ক্ষতি হলে ডিএনএর ভাঙন মেরামত করা। বিশেষ করে যখন ডিএনএর দুটি শাখা একসঙ্গে ছিঁড়ে যায় (যাকে বলে “দ্বি-দণ্ড ভাঙন”), তখন CIRBP দ্রুত সক্রিয় হয়ে কোষকে পুনরুদ্ধার করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, বো হেড তিমির কোষ ডিএনএ ভাঙনের পর অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে অনেক দ্রুত নিজেকে মেরামত করতে পারে। এরা ব্যবহার করে দুটি কৌশল।যথা-
ক. সমজাতীয় পুনর্গঠন- যা অত্যন্ত নির্ভুলভাবে ক্ষতি রিপু করে।
খ. অসমজাতীয় প্রান্ত সংযোজন- যেখানে ভুলের সম্ভাবনা আশ্চর্যভাবে কম।
আরও আশ্চর্যের বিষয়, যখন গবেষকরা এই প্রোটিনের কার্যক্ষমতা তিমির কোষে কমিয়ে দেন, তখন মেরামতের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। উল্টোভাবে, এই প্রোটিন বাড়িয়ে দিলে, কোষের পুনরুদ্ধার ক্ষমতা বেড়ে যায়। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই CIRBP-ই বো হেড হোয়েলের দীর্ঘায়ুর অন্যতম মূল চাবিকাঠি। চরম ঠান্ডা সুমেরু সাগর। সেখানে জলের তাপমাত্রা প্রায় -৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও কম। এমন শীতল পরিবেশই CIRBP প্রোটিনকে সক্রিয় রাখে। মানব কোষেও ঠান্ডা পরিবেশে এই প্রোটিনের মাত্রা বাড়তে দেখা গেছে। অর্থাৎ, পরিবেশ ও কোষ প্রক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে সুনিপুণ সামঞ্জস্য রেখে চলে। এ যেন প্রকৃতির এক নিখুঁত রসায়ন। ঠান্ডা জল, সুনির্দিষ্ট প্রোটিন আর কার্যকর কোষ মেরামতি প্রক্রিয়া মিলে তৈরি করেছে দীর্ঘায়ুর নিখুঁত ছক। প্রধান বিজ্ঞানী ভেরা গর্বুনোভা বলেছেন, “আমরা এখনও কোনো ‘অমরত্বের সূত্র’ পাইনি, তবে পেয়ে গেছি এক সম্ভাবনার মানচিত্র।“ মানবদেহে কোষের বার্ধক্য, ক্ষয় এবং মেরামতের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য আছে। যদি বো হেড তিমির মতো কোষ-সংশোধনের প্রক্রিয়াকে নিরাপদভাবে বাড়ানো যায়, তবে একদিন হয়তো আমরা বার্ধক্য বা কোষবিকৃতির বিরুদ্ধে নতুন চিকিৎসা কৌশল তৈরি করতে পারব।
সূত্র : Evidence for improved DNA repair in long-lived bowhead whale by Denis Firsanov ; et.el; Published: 29 October 2025
