ডার্ক ম্যাটার হলো মহাবিশ্বের অদৃশ্য, অজানা পদার্থ যা আলো বা অন্য কোনো তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের সাথে যুক্ত নয়। এটি শুধুমাত্র মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি প্রকাশ করে, যা সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিশ্বের মোট পদার্থের প্রায় ২৭% হলো ডার্ক ম্যাটার।
সম্প্রতি তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের অন্ধকার যুগ থেকে আসা ক্ষীণ রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে এই অদৃশ্য ও রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার সম্বন্ধে নতুন ধারণা দিচ্ছেন। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী, মহাবিশ্বের একেবারে প্রাচীন সময়ে, অর্থাৎ বিগ ব্যাং-এর প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর পর কোনো তারা বা তারা-নিবাস ছায়াপথ জন্ম নেয়নি। শুধুমাত্র ছড়িয়ে ছিল হাইড্রোজেন গ্যাস ও ডার্ক ম্যাটার। পুঞ্জীভূত ডার্ক ম্যাটার আশেপাশের হাইড্রোজেন গ্যাসকে আকর্ষণ করেছিল। এই আন্ত ক্রিয়ার ফলে হাইড্রোজেন বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রেডিও সংকেত বিকিরণ করেছিল, যা আজও মহাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। এটিই মহাবিশ্বের প্রায় ৮৫% ভর বহন করে। এগুলো বিশ্লেষণ করেই ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি বোঝা যেতে পারে।
এই সংকেত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আটকা পড়ে। তাই বিজ্ঞানীদের প্রস্তাব, চাঁদের পৃষ্ঠে রেডিও টেলিস্কোপ স্থাপন করা হোক। সেখানে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই, নেই মানুষের তৈরি ইলেকট্রনিক শব্দ। ফলে মহাবিশ্বের আদিম রেডিওর ফিসফিসানি সহজেই ধরা পড়বে।
এমন প্রযুক্তি নির্মাণ সহজ নয়। কিন্তু এখন যেহেতু আমেরিকা, ইউরোপ, চীন ও ভারত সবাই নতুন চন্দ্রাভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতেই পারে যেকোনো দিন।
তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাকলার স্কুল অব ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি থেকে গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রফেসর রেনান বারকানা, সঙ্গে পিএইচ ডি গবেষক সুদীপ্ত সিকদার এবং জাপান, ভারত ও যুক্তরাজ্যের অন্যান্য বিজ্ঞানী। তাঁদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি পত্রিকায়। জানা গেছে, মহাবিশ্বের প্রথম তারাগুলোর জন্মের পিছনেও ডার্ক ম্যাটারের এইসব ঘন গুচ্ছগুলির ভূমিকা ছিল।
কম্পিউটার সিমুলেশন অনুযায়ী, ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্ব জুড়ে ছোট ছোট ঘন গুচ্ছ বা “পিন্ড ” আকারে জমাট বাঁধে। এই গুচ্ছগুলোর আকৃতি ও আকার নির্ভর করে ডার্ক ম্যাটারের অজানা বৈশিষ্ট্যের ওপর। সরাসরি দেখা না গেলেও, তারা যে হাইড্রোজেনকে টেনে নিয়েছিল এবং রেডিও সংকেত তৈরি করেছিল, তার প্রভাব রেডিও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধরা সম্ভব হতে পারে।
এই সংকেত অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও, যদি একে ধরা যায় তবে এটিই হবে ডার্ক ম্যাটার অধ্যয়নের ইতিহাসে আরও এক নতুন অধ্যায় বা নিশানা। বিশেষত, ‘বর্গ কিলোমিটার বিন্যাস’ (এস কে এ) নামক বিশাল আন্তর্জাতিক প্রকল্পে ৮০,০০০ রেডিও অ্যান্টেনা ব্যবহার করে এমন মানচিত্র তৈরি করা হবে যার মাধ্যমে অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের ছায়াও ধরা পড়তে পারে।
প্রফেসর বারকানা বলেন, যেমন পুরানো রেডিও স্টেশনগুলিকে নতুন প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে ওয়েবসাইট এবং পডকাস্ট নিয়ে এসে, তেমনি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করছেন। এই গবেষণা শুধু মহাবিশ্বের প্রাচীন অতীত নয়, ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রেও এক মূল্যবান পদক্ষেপ হতে পারে।
এই প্রাচীন রেডিও সংকেতই হয়তো আমাদের জানাতে চলেছে মহাবিশ্বের সেই আদিম অনন্ত সবচেয়ে রহস্যময় সত্তা ডার্ক ম্যাটার আসলে কী দিয়ে গঠিত, আর কীভাবে তা আমাদের তারাভরা আকাশকে গড়ে তুলেছিল।
সূত্র : “The signature of subgalactic dark matter clumping in the global 21-cm signal of hydrogen” by Rennan Barkana, Sudipta Sikder,et.al;(16.09.2025), Nature Astronomy.
DOI: 10.1038/s41550-025-02637-0
