কানপুরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির সহযোগিতায় দিল্লি সরকার গত ২৮ অক্টোবর দিল্লি শহরের দূষণ কমানোর উদ্দেশ্যে ক্লাউড সিডিং বা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। পরপর দুটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস করা হয়েছিল। খরচ হয় প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা। প্রথাগত পদ্ধতিতে দিল্লির বিভিন্ন এলাকার উপর দিয়ে একটি ছোটো বিমান উড়িয়ে তার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে সিলভার আয়োডাইড ও সাধারণ লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড প্রভৃতি পদার্থ মেঘের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল যাতে মেঘের ভেতরের জলকণা একত্রিত হয়ে বৃষ্টির আকারে ভূমিতে অধঃক্ষিপ্ত হয়। এই প্রচেষ্টার ফলে নয়ডা ও গ্রেটার নয়ডায় মেঘে পর্যাপ্ত আর্দ্রতার অভাব থাকা সত্ত্বেও ০.৩ মিমি. বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। তবে বৃষ্টির এই পরিমাণ বায়ু দূষণ কমানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
তবে এই কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের পরীক্ষামূলক প্রয়াস একেবারেই কোনো আনকোরা অভিজ্ঞতা নয়। এ আসলে পুরনো প্রচেষ্টারই আধুনিক সংস্করণ । কারণ এই দিল্লিতেই, প্রায় ৭০ বছর আগে ১৯৫৭ সালে, একদল ভারতীয় বিজ্ঞানী প্রথম আকাশে বৃষ্টির বীজ বপনের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল মানুষের হাতেই আকাশ থেকে বৃষ্টি নামানো।
১৯৫৭ সালের পরীক্ষাটি পরিচালনা করেছিল ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি (এন পি এল)-র “রেইন অ্যান্ড ক্লাউড ফিজিক্স রিসার্চ ইউনিট” (আর সি পি আর)। এই গবেষণা ইউনিটটি ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে এটি পুনের “ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিকাল মেটিওরোলজি”-তে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে আজও বৃষ্টি ও মেঘবিজ্ঞানের উপর গবেষণা চলছে।
ওই উদ্যোগের অনুপ্রেরণা এসেছিল আমেরিকার বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট শ্যাফার-এর কাছ থেকে। তিনি ১৯৪৬ সালে প্রথম পরীক্ষাগারে কৃত্রিম তুষারপাত ঘটিয়ে দেখান যে, বাতাসে নির্দিষ্ট রাসায়নিক ছিটালে মেঘ ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি বা তুষার তৈরি করতে পারে। এই সাফল্যের পর পরই বিশ্বের নানা প্রান্তে শুরু হয় মেঘে বৃষ্টির বীজ বপনের গবেষণা, যার ঢেউ এসে পৌঁছায় ভারতে। সেই আশ্চর্য আবিষ্কার ভারতীয় বিজ্ঞানীদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে।
ফলস্বরূপ ভারতের প্রথম ক্লাউড সিডিং অভিযান হয় ১৯৫১ সালে টাটা ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে, পশ্চিমঘাটের আকাশে। এক বছর পর ভারতের প্রথম আবহাওয়া দপ্তরের প্রধান পরিচালক এস. কে. ব্যানার্জি এই প্রযুক্তিকে সরকারি প্রকল্পে রূপ দেন। এরপর ১৯৫৭ সালে দিল্লিতে শুরু হয় বৃহৎ পরিসরের পরীক্ষা। ছোট বিমান উড়িয়ে আকাশে ছড়ানো হয় সিলভার আয়োডাইড ও সোডিয়াম ক্লোরাইড (লবণ), যাতে মেঘের জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি নামায়। পরীক্ষাটি পরিচালিত হয়েছিল বর্ষাকালে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে যখন মেঘে আর্দ্রতা প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি থাকে। পরীক্ষার আগে বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেন আকাশের আবহাওয়া পরিস্থিতি, মেঘের ঘনত্ব, তাপমাত্রা ও বায়ুর গতি—যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পরিবেশটি বৃষ্টির জন্য উপযুক্ত। তাঁরা লক্ষ্য করেন, মেঘে প্রাকৃতিকভাবে থাকা লবণকণা ও ধূলিকণা বৃষ্টির ফোঁটা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বিমান থেকে ছিটানো এই কৃত্রিম কণাগুলো মেঘের ঘনীভবন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
তবে ১৯৫৭ সালের ফলাফল স্পষ্ট ছিল না। তিনটি স্প্রে যন্ত্র ব্যবহার করে কয়েক ঘণ্টার জন্য আকাশে লবণ ছিটানো হয়েছিল, কিন্তু মেঘের পরিবেশ তখনও বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত ছিল না। ১৯৬১ সালের এক প্রতিবেদনে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের বিজ্ঞানী আর. আর. কেলকার লিখেছিলেন—“কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটানো বিজ্ঞানের পাশাপাশি ধৈর্য ও শিল্পের কাজ।” তিনি বোঝান মেঘের ঘনত্ব, বাতাসের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা সবকিছু উপযুক্ত না হলে বৃষ্টি নামানো সহজ নয়। কোনো রাসায়নিকই কাজ করে না। তবুও তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন যে এই পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে সহজ, সাশ্রয়ী এবং ব্যবহারযোগ্য।
১৯৫৮ ও ১৯৫৯ সালেও একই ধরণের পরীক্ষা চালানো হয়, কিন্তু কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। তবুও এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ নয়; বরং এটি ভারতের আবহাওয়া বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বড়ো সূচনা হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এখান থেকেই শুরু হয়েছিল মানুষের প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের প্রথম বাস্তব চেষ্টা।
আজ, ২০২৫ সালে, আবার সেই পুরনো স্বপ্ন ফিরে এসেছে নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে। আইআইটি কানপুরের গবেষকরা এখন সেই একই পদ্ধতিতে দূষণ কমানোর চেষ্টা করছেন – ঠিক যেমনটা তাঁদের পূর্বসূরিরা করেছিলেন সাত দশক আগে।
আজকের আধুনিক ক্লাউড সিডিং প্রকল্পগুলো সেই ১৯৫০-এর দশকের গবেষণারই উত্তরাধিকার বহন করে চলছে।
সূত্র : Nearly seven decades ago,a bid to seed clouds by senior correspondent writer of The Indian Express.
