অতিকায় নক্ষত্রে গড়া প্রাচীন ব্রহ্মাণ্ড 

অতিকায় নক্ষত্রে গড়া প্রাচীন ব্রহ্মাণ্ড 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৫ নভেম্বর, ২০২৫

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একেবারে প্রারম্ভিক যুগে, সূর্যের চেয়ে হাজার হাজার গুণ বৃহৎ ও উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোই নাকি ছিল ছায়াপথ আর নক্ষত্রগুচ্ছগুলোর জন্মের নেপথ্যে মূল চালিকা শক্তি। বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় এই বিশেষ তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির মাসিক নোটিশে প্রকাশিত পত্রিকায়। গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন মার্ক গিলেস ,যিনি ইউনিভার্সিটি অফ বার্সেলোনার ইনস্টিটিউট অফ কসমস সায়েন্সেস এবং কাতালোনিয়ার ইনস্টিটিউট অফ স্পেস স্টাডিজ -এর গবেষক। তাঁদের তৈরি নতুন মডেল অনুযায়ী, সূর্যের ভরের ১,০০০ থেকে ১০,০০০ গুণ বেশি ভরবিশিষ্ট “অত্যন্ত বিশাল নক্ষত্র” প্রাথমিক মহাবিশ্বের প্রাচীনতম নক্ষত্রগুচ্ছগুলির গঠন ও রাসায়নিক গঠনে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। এদের বলা হয় গ্লোবুলার ক্লাস্টার।

গ্লোবুলার ক্লাস্টার হলো অসংখ্য নক্ষত্রের ঘন গোলাকার সমষ্টি, যেখানে লাখ থেকে কোটি নক্ষত্র একত্রে গুচ্ছাকারে থাকে। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ সহ প্রায় সব ছায়াপথেই এ ধরনের নক্ষত্রগুচ্ছ দেখা যায়। এগুলির বয়স সাধারণত ১০ বিলিয়ন বছরেরও বেশি, অর্থাৎ মহাবিশ্বের জন্মের পরপরই এরা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু এসব নক্ষত্রগুচ্ছের ভেতরের নক্ষত্রগুলোর রাসায়নিক উপাদানে দীর্ঘদিন ধরেই অদ্ভুত বৈচিত্র্য দেখা যায় — হিলিয়াম, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামের অস্বাভাবিক পরিমাণ। দীর্ঘদিন যাবৎ বিজ্ঞানীরা এই রাসায়নিক বৈচিত্র্যের উৎস বুঝতে পারেননি, তাঁরা যথেষ্ট বিভ্রান্ত হয়েছেন। তবে, এখন গবেষকরা মনে করেন, এই বৈচিত্র্যের উৎস হলো ক্লাস্টার গঠনের সময়কার জটিল রাসায়নিক মিশ্রণ প্রক্রিয়া।

 

এই গবেষণাটির মূল ভিত্তিই হল জাড্যর কারণে গ্যাসের অভ্যন্তরীণ প্রবাহ নামে পরিচিত নক্ষত্রগঠনের একটি তত্ত্ব । এই মডেল অনুযায়ী, বিশাল গ্যাসীয় মেঘের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা ও অশান্ত প্রবাহের ফলে জন্ম নিতে পারে সূর্যের চেয়েও ১,০০০–১০,০০০ গুণ বেশী ভরবিশিষ্ট নক্ষত্র। এই অতিকায় নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী নাক্ষত্রিক বাতাস নির্গত করে, যা চারপাশের বিশুদ্ধ গ্যাসের সঙ্গে মিশে নতুন প্রজন্মের নক্ষত্র তৈরি করে—যাদের রাসায়নিক উপাদান ভিন্ন। এই প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র ১ থেকে ২ মিলিয়ন বছরের মধ্যে, সুপারনোভা বিস্ফোরণের আগেই, ফলে ক্লাস্টারের গ্যাস দূষিত হয় না।

গবেষক মার্ক গিলেসের মতে, মাত্র কয়েকটি বিশাল নক্ষত্রই একটি গোটা ক্লাস্টারের রাসায়নিক পরিচয় বদলে দিতে পারে। এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, আজ আমরা যেসব প্রাচীন গোলাকৃতির নক্ষত্রগুচ্ছে রাসায়নিক বৈচিত্র্য দেখি, তার মূল উৎস এই বিশাল নক্ষত্রগুলোই। আজও সেই রাসায়নিক স্বাক্ষর টিকে আছে।

গবেষকরা আরও জানান, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে পর্যবেক্ষণ করা নাইট্রোজেন-সমৃদ্ধ প্রাচীন ছায়াপথগুলো সম্ভবত এই অতিকায় নক্ষত্র-সমৃদ্ধ গোলাকার নক্ষত্র সমষ্টির ফল। এই বিশাল নক্ষত্রগুলো তাদের জীবনের শেষে মধ্যম ভরের ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়েছে, যেগুলো এখন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব।

এই গবেষণা আমাদের এক নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়েছে, প্রমাণ করেছে, মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক যুগে এই অতিবৃহৎ নক্ষত্ররাই ছিল ছায়াপথ, নক্ষত্রগুচ্ছ ও ব্ল্যাক হোল গঠনের মূল স্থপতি।

 

সূত্র : “Globular cluster formation from inertial inflows: accreting extremely massive stars as the origin of abundance anomalies” by Mark Gieles, Paolo Padoan,et.al; 4th November 2025, Monthly Notices of the Royal Astronomical Society.

DOI: 10.1093/mnras/staf1314.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten + 1 =