সেলিম আলির স্বপ্ন ডানা মেলছে

সেলিম আলির স্বপ্ন ডানা মেলছে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ নভেম্বর, ২০২৫

ভারতের পক্ষীবিদ্যার ইতিহাসে “ভারতের পক্ষীমানব” সেলিম আলি এক কিংবদন্তি। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার শুধু এই একটি উপাধিতে সীমিত নয়। তিনি ভারতের আধুনিক পক্ষীবিজ্ঞান ও জনসচেতনতার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। ২০২৫ এ তাঁর জন্মমাস নভেম্বরকে ঘিরে তামিলনাড়ু সহ গোটা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রচার। “#বার্ডনভ২০২৫”। এই প্রচারে মানুষ নিজেদের তোলা পাখির ছবি, আঁকা, রীল ভিডিও ও তথ্যভিত্তিক পোস্ট শেয়ার করছে। ছয় বছর আগে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ এখন পরিণত হয়েছে এক জাতীয় পর্যায়ের উদ্‌যাপনে। অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরল, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, আসাম, এমনকি আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকেও অংশগ্রহণকারীরা যুক্ত হচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটাই। পাখিদের প্রতি ভালোবাসা ও সংরক্ষণের বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন নানা বয়স, পেশা ও দেশের মানুষ। তাদের মধ্যে কিছু নাম দেখে নেওয়া যাক –

সালভা গণেশ, তামিলনাড়ুর এক শিক্ষক, টানা ১৩ বছর ধরে তরুণদের পাখি ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলছেন। তাঁর কথায়, “সামাজিক মাধ্যম এখন শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি শিক্ষা ও সচেতনতার শক্তিশালী মঞ্চ হয়ে উঠেছে। এখানে পাখির গল্পও ভাইরাল হতে পারে।”

আমেরিকার টেক্সাস নিবাসী ভারতীয় শিল্পী বিদ্যা সুন্দর , নিয়মিত ভারতীয় পাখিদের রঙিন চিত্র এঁকে পোস্ট করেন অনলাইনে। তাঁর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে গুবাচি, কোকিল, প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচারের মতো প্রজাতি।

কর্ণাটকের নিশ্চিতা, ফুলের পাপড়ি ও শুকনো পাতায় তৈরি করেন রঙিন পাখির কোলাজ। যেমন- ফ্লেমিঙ্গো বা ব্রাহ্মিণী ঘুঘু। তাঁর মতে, “প্রকৃতি থেকেই প্রকৃতিকে শেখা সবচেয়ে সহজ।”

মাদুরাইয়ের অনীতা বীরাভেন্দ্রন, যিনি একদিকে গৃহিণী, অন্যদিকে বন্যপ্রাণ ফটোগ্রাফার। তিনি তৈরি করেছেন এক অনলাইন প্রদর্শনী। সেখানে দেখা যায় “গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড”, “ডোডো” ও “গ্রেট হর্নবিল”-এর মতো বিরল ও বিলুপ্ত পাখির চিত্র। তিনি বলেন, “আমাদের ঘরের জানালার বাইরেও এক বিশাল জীববৈচিত্র্যের জগৎ আছে। সেটিকে চিনতে শেখাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য।”

একইভাবে তিরুপতির ভারতীয় বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআইএসইআর তিরুপতি-এর নাগরিক বিজ্ঞান সমন্বয়ক এ. এস. হরীশা, এই নিয়ে দ্বিতীয় বছর আয়োজন করেছেন “বার্ড ওয়াক”। এতে সাধারণ মানুষ অংশ নিচ্ছেন মাঠে হেঁটে পাখি চেনার অনুশীলনে।

এই উদ্যোগ কেবল ছবি তোলা বা পাখি দেখার আনন্দেই থেমে নেই; এটি হয়ে উঠেছে এক “জনবিজ্ঞান” আন্দোলন। অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, তাদের আবাসস্থল, ঋতুভিত্তিক আগমন-প্রস্থান নিয়ে তথ্য ভাগ করে নিচ্ছেন অনলাইনে। ফলে, গবেষকদেরও হাতে আসছে স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত। তরুণ প্রজন্মের কাছে এ এক শিক্ষামূলক প্রয়াসও বটে। বহু স্কুল-কলেজে ছোট ছোট পাখি-পর্যবেক্ষণ ক্লাব গড়ে উঠছে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই গাইড তৈরি করছে। “আমার এলাকার পাখি” নামে ছোট ছোট বুকলেট বা ব্লগ বানাচ্ছে। এমন কার্যক্রম শুধু পরিবেশ সচেতনতা নয়, বস্তুত “বিজ্ঞানভিত্তিক নাগরিকতা”-র ধারণাকে বাস্তবায়িত করছে। সেখানে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণও নাগরিক দায়িত্বের অংশ হয়ে উঠছে।
সেলিম আলি (১৮৯৬–১৯৮৭) ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম পাখি নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, “প্রকৃতিকে বোঝার জন্য প্রথমে তাকাতে জানতে হয়।” তাঁর পথ ধরে আজকের “বার্ডনভ” আন্দোলন শুধু তাঁর কাজের স্মারক নয়, বরং সেই দৃষ্টিভঙ্গিকেই নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছে। সেলিম আলির প্রেরণা, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমের শক্তি- এই তিনের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এক নতুন সমাজ-পরিবেশগত প্রবাহ।

সূত্র : Giving wings to Salim Ali’s efforts in ornithology; The New Indian Express; 06 Nov 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 + twenty =