স্নায়ুবিজ্ঞানীর স্বচক্ষে জীবন্ত মস্তিষ্কপাঠ

স্নায়ুবিজ্ঞানীর স্বচক্ষে জীবন্ত মস্তিষ্কপাঠ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ নভেম্বর, ২০২৫

কম্পিউটেশনাল স্নায়ুবিজ্ঞানী সারা লারিভিয়ের সাধারণত মস্তিষ্ককে বোঝেন গাণিতিক সমীকরণ, তথ্যবিন্দু এবং ত্রিমাত্রিক মডেলের মাধ্যমে। তাঁর কাজ হলো উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মানব মস্তিষ্কের মানচিত্র আঁকা। কিন্তু একদিন নিউরোসার্জেন ড. সামি ওবাইদের সঙ্গে বাস্তব অপারেশন থিয়েটারে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন জীবন্ত মস্তিষ্ক , যা স্পন্দিত, নরম, এবং অসম্ভব জটিল। সেই দৃশ্য তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এক গভীর পরিবর্তন আনল।

সেদিনেরই কিছু চিত্র তুলে ধরা হল। সময় তখন ভোর ছটা। অন্ধকারে বরফে ঢাকা পথ দিয়ে দীর্ঘ যাত্রার পর তিনি পৌঁছান ওবাইদের অপারেশন রুমে। সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন চামড়া সরানো হচ্ছে, খুলির অস্থি ড্রিল করে ফুটো করা হচ্ছে, পেলেন দগ্ধ টিস্যুর তীব্র গন্ধ, এবং সবশেষে দৃষ্টিগোচর হলো এক জীবন্ত, নরম, স্পন্দিত মস্তিষ্ক। সেই দৃশ্য তাঁর কাছে কেবল বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ই নয়, ছিল অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর গবেষণার মোড় ঘোরানো এক অভিনব অভিজ্ঞতা। যে মস্তিষ্ক তিনি এতদিন কেবল পর্দায় দেখেছেন, সেখানে এবার তাঁর চোখের সামনে এর জীবন্ত সাক্ষাৎ মিলল।

লারিভিয়ের উপলব্ধি করেন, গবেষণাগারে তৈরি মডেলগুলো যত নিখুঁতই হোক, সেগুলো বাস্তবতার ছায়ামাত্র, বাস্তব নয়। ল্যাবে তিনি মস্তিষ্ককে টুকরো টুকরো করে গণিতের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন, অঞ্চলভিত্তিক চিহ্নিত করেন, সংযোগগুলিকে রঙিন মানচিত্রে সাজান। কম্পিউটারে যে অঞ্চলের সীমানা পরিষ্কার, সার্জনের দৃষ্টিতে তা মিলেমিশে একাকার। সব কিছুই পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, একরঙা থকথকে পদার্থ জেলোর মতো।

এই বাস্তব অভিজ্ঞতা তাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, তাঁরা কি সত্যিই মস্তিষ্ক ঠিক যেমন, সেই ভাবে মডেল করছেন? নাকি সে মডেল কেবল তার একটি সরলীকৃত কল্পনা? অল্প কয়েকটি অস্ত্রোপচার দেখেই তিনি উপলব্ধি করেন, কোনো দুটি মানব মস্তিষ্ক কখনো এক নয়। প্রতিটি মস্তিষ্কের আলাদা গঠন, সংযোগ এবং ভাঁজ। সব কিছুতেই ব্যক্তিগত পার্থক্য স্পষ্ট। গড় মডেলের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এই স্বাতন্ত্র্যকে আড়াল করতে পারে। তাই তিনি এখন তাঁর গবেষণায় ব্যক্তিভিত্তিক ইমেজিং উপাত্তকে অগ্রাধিকার দেন। যাতে মডেলগুলো বাস্তব মানব মস্তিষ্কের প্রকৃত রূপকে প্রতিফলিত করতে পারে।

অপারেশন চলাকালীন তাঁর ও ওবাইদের মধ্যে আলোচনায় এই দুই জগতের সংযোগ আরও গভীর হয়। লারিভিয়ের শেখেন, বাস্তব মস্তিষ্কের জটিলতা না বুঝলে মডেলকে আরো উন্নত করা যায় না, আর ওবাইদ স্বীকার করেন কম্পিউটেশনাল মডেলগুলো তাঁর অস্ত্রোপচারকে আরও সঠিক ও নিরাপদ করে তুলছে। তাঁদের এই পারস্পরিক সহযোগিতাই দেখায় যে চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের সংযোগ কতটা জরুরি। তাঁদের মতে এটাই ভবিষ্যতের স্নায়ুবিজ্ঞানের অগ্রগতির চাবিকাঠি। উন্নত ইমেজিং ও মডেলিং এখন সার্জারিকে করছে আরও নিরাপদ, নিখুঁত ও মানবকেন্দ্রিক।

 

দিনের শেষে গাড়ি চালিয়ে ফেরার সময় সারা লারিভিয়েরের মনে ভিড় করে আসছিল এমন সব নতুন ভাবনা, নতুন ধারণা ও এমন সব প্রশ্ন, যেগুলোর অস্তিত্ব কয়েক ঘণ্টা আগেও ছিল না। তাঁর একটাই অনুভূতি কাজ করছিল: যে মস্তিষ্ক তিনি দেখলেন তা কেবল একটি জৈব অঙ্গ নয়, তা এক মানবজীবনের প্রতীক। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রতিদিন ব্যবহৃত কম্পিউটেশনাল মডেলগুলো কি সত্যিই মস্তিষ্কের বাস্তব জটিলতাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করে? এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে জন্ম নেয় নতুন অনুসন্ধান। কীভাবে মডেলগুলোকে আরও নিখুঁত, মানবকেন্দ্রিক ও বাস্তবতার কাছাকাছি করা যায়। তিনি উপলব্ধি করেন, একজন স্নায়ুবিজ্ঞানীর জন্য শুধু কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে থাকাই যথেষ্ট নয়; জীবন্ত মস্তিষ্কের জটিলতাকে সরাসরি দেখা ও বোঝা এক অপরিহার্য শিক্ষানুভব। এই অনুভূতিই তাঁর গবেষণাকে নতুন করে সমৃদ্ধ করেছে।

 

সূত্র : What witnessing neurosurgery taught me about modeling the brain by Sara Larivière, Sami Obaid, et.al; published in Nature Methods ,6th November,2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty − 12 =