জিনের পুনর্জন্ম : হৃৎপিন্ডের স্ব-আরোগ্য  

জিনের পুনর্জন্ম : হৃৎপিন্ডের স্ব-আরোগ্য  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ নভেম্বর, ২০২৫

হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের বা গুরুতর কোনো হৃদরোগের পর আপনার নিজের হৃদয়ই যদি নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে, নতুন কোষ তৈরি করে আগের মতো কাজ করতে পারে—তবে কেমন হয়? অবিশ্বাস্য শোনালেও, বিজ্ঞানীরা এগিয়ে চলেছেন এই স্বপ্নকেই বাস্তবের মাটিতে ভূমিষ্ঠ করতে। সম্প্রতি মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের বিজ্ঞানীরা এমন এক মানব জিনের সন্ধান পেয়েছেন, যা মানুষের হৃদযন্ত্রকে নিজেই নিজের ক্ষত সারাতে সক্ষম করতে পারে।

এই জিনটির নাম সাইক্লিন এ 2 (সিসিএনএ 2)। এটি আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই থাকে, কিন্তু জন্মের পরই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, এই জিনটিকে যদি আবার সক্রিয় করা যায়, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হৃদপেশির কোষ পুনরায় আপনা আপনি বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি করতে পারে। এই আবিষ্কার হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের পর ক্ষতিগ্রস্ত হৃদযন্ত্রের মেরামত প্রক্রিয়ায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

এই অনবদ্য গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে এন পি জে রিজেনারেটিভ মেডিসিন জার্নালে। এটি পরিচালনা করেছেন ড. হিনা চৌধুরি, যিনি মাউন্ট সিনাই আইকান স্কুল অফ মেডিসিনের কার্ডিওভাসকুলার রিজেনারেটিভ মেডিসিন বিভাগের পরিচালক। তিনি ও তাঁর দল প্রমাণ করেছেন যে মানুষের হৃদপেশির কোষ, যা সাধারণত জন্মের পর আর বিভাজিত হয় না, সেটিকেও সিসিএনএ ২ জিনের সক্রিয়তার মাধ্যমে আবার নব অপত্য কোষ তৈরিতে উৎসাহিত করা সম্ভব।

এই আবিষ্কার ড. চৌধুরির ২০১৪ সালের এক গবেষণার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে তিনি ও তাঁর দল প্রথমবারের মতো শূকরের হৃদযন্ত্রে (যার গঠন মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলে) সিসিএনএ ২জিন সক্রিয় করে সফলভাবে হৃদযন্ত্রর পুনর্জন্ম ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। নতুন গবেষণায় সেই ধারণাটিকেই মানব কোষে প্রয়োগ করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, মানুষের হৃদকোষেও একই প্রক্রিয়া কার্যকর হতে পারে।

এই গবেষণায় তাঁরা একটি নিরাপদ, মানব-সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাইরাল ভেক্টর ব্যবহার করে সিসিএনএ 2 জিনটি তিনজন সুস্থ দাতার (বয়স ২১, ৪১ এবং ৫৫ বছর) হৃদপেশির কোষে প্রবেশ করান। দেখা যায়, ৪১ ও ৫৫ বছর বয়সী হৃদযন্ত্রের কোষে সাইক্লিন এ 2 প্রয়োগের পর কোষগুলো সফলভাবে বিভাজিত হয়েছে এবং তাদের স্বাভাবিক গঠন ও কার্যক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। কিন্তু ২১ বছর বয়সী হৃদযন্ত্রের কোষে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি—যা ইঙ্গিত করে যে কমবয়সী হৃদয়ে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা পুনর্গঠন ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। এই সঙ্গে একই সাথে এও ইঙ্গিত করে যে, বয়স বাড়লে হৃদয়ের পুনর্গঠন ক্ষমতা হারিয়ে যায়, যা এই জিন সহজেই পুনরুদ্ধার করতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নতুন করে তৈরি হওয়া অপত্য কোষগুলির ক্যালসিয়াম ক্রিয়াশীলতা ও গঠন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল।এবং সিসিএনএ ২ জিন কোষের সময়চক্রকে সাময়িকভাবে পেছনে ফিরিয়ে দেয়, ফলে কোষগুলো পুনরায় বিভাজনের ক্ষমতা ফিরে পায়। তবে এই প্রক্রিয়ায় কোষ অপরিণত বা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় না, বরং সঠিকভাবে হৃদপেশি মেরামতের কাজে অংশ নেয়।

ড. চৌধুরি বলেন, আজকে তাঁদের এই সাফল্য দুই দশকের নিরলস পরিশ্রমের ফল। একদিন তাঁরাই দেখিয়েছিলেন যে, ঘুমিয়ে থাকা জিনকে পুনরুজ্জীবিত করেই হৃদযন্ত্রের পুনর্গঠন সম্ভব। আজ তাঁদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দোরগোড়ায়।

 

এখন গবেষকদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো এফ ডি এ অনুমোদন নিয়ে মানুষের ওপর সিসিএনএ ২ থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা। যদি এটি সফল হয়, তাহলে ভবিষ্যতে হৃদযন্ত্রের প্রতিস্থাপন বা কৃত্রিম পেসমেকার ছাড়াই নিজের হৃদয় নিজেই নিজের ক্ষত সারাতে পারবে—যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক ঐতিহাসিক উত্তরণ হিসেবে বিবেচিত হবে।

 

সূত্র: Specific human gene can help the heart repair itself from heart attack or heart failure by The Mount Sinai Hospital. Published in Mice, npj Regenerative Medicine ,3.11.2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × two =