বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধ

বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২২ নভেম্বর, ২০২৫

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলি ভয়ঙ্কর সব তথ্য দিয়ে চলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে, উপকূল ও কৃষি অঞ্চল ঝুঁকির মুখে।তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, জনমানস ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার, সবই যেন বিপদের গুরুত্বর তুলনায় অবজ্ঞাসূচকভাবে নিশ্চল। প্রশ্ন জাগে, বিজ্ঞান কি তার সতর্কবাণী পৌঁছে দিতে ব্যর্থ ? নাকি সমাজই শুনতে রাজি নয়? এই প্রশ্নের ভিন্ন এক উত্তর খুঁজছেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দিতা ব্যানার্জি। তিনি মনে করেন, জলবায়ু সংকট কেবল বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়। এটি কল্পনা, অর্থবহতার এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণের সংকট। বিজ্ঞান আমাদের বলে দেয় পৃথিবীর তাপমাত্রা কত ডিগ্রি বাড়ছে। কিন্ত এই উষ্ণতা দিল্লির রিকশাচালকের শরীরে কী প্রভাব ফেলবে, কিংবা সুন্দরবনের কোনো বাঁধ ভাঙলে কোথায় যাবে কোন মা হারা শিশু – সেটা কি বোঝাতে পারে? ব্যানার্জির গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জনসাধারণের নিষ্ক্রিয়তার একটি বড় কারণ হল, বিপদকে ব্যক্তিগত বর্ণনায় রূপান্তর করতে না পারা। তার মতে, বৈজ্ঞানিক তথ্য যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, গল্প না হলে তা মানুষের মনে গাঁথা যায় না। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও স্থায়িত্ব কর্মসূচির অধীনে তিনি “পরিবেশ-মানবিক বিদ্যা” নামের একটি বিশেষ ধারা গড়ে তুলছেন। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো “দুরূহ ও জটিল” সমস্যা শুধু সংখ্যাতত্ত্ব বা গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে সমাধান করা যায় না। “তথ্য কেবলমাত্র সংকট দেখায়, কিন্তু গল্প মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।“ তিনি দেখাচ্ছেন, উপনিবেশবাদ শুধু ভূখণ্ড দখল নয়, পরিবেশকে সম্পদে পরিণত করার এক বৈধ রাজনীতিতে পরিণত করে। বনাঞ্চল হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যের জ্বালানি, নদী হয় ব্যবসায়িক লাভের স্রোত। সাহিত্য ও লোককথা, সায়েন্স ফিকশন শুধুই বিনোদন নয়। তারা ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের পরীক্ষাগার। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎকে কল্পনার অণুবীক্ষণে দেখা যায়। যেখানে উপকূল সিদ্ধান্ত নেয়, মরুভূমি কথা বলে, মানুষ মুখোমুখি হয় নিজের নির্মিত পৃথিবীর। তাই ক্লাসরুমে শুধু বৈজ্ঞানিক গ্রাফ নয়; উঠে আসে রেচেল কার্সনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ এর বিষাক্ততা, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলো’–র মানব-মনস্তত্ত্ব, সাইবেরিয়ান অভিবাসন ও জলবায়ু-জড়িত যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের ইতিহাস। অতীতের পরিবেশ-নির্ভর সভ্যতা, বর্তমানের সঙ্কট এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে তারা এক সুতোয় গাঁথে। তরুণ গবেষকরা এর মাধ্যমেই জলবায়ু সংকট বলতে ‘গ্রহ বনাম মানুষ’ নয়, বরং মানুষের মধ্যেকার ‘মূল্যবোধ বনাম লাভ’ – এর তুলনা টানবে। যেখানে পৃথিবী শত্রু বলে গণ্য হবে না, শুধু মানুষের নৈতিকতাকে কষাঘাত করা যাবে।

বিশ্বজুড়ে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তি, কার্বন বাণিজ্য, কার্বন-হ্রাস প্রযুক্তিতে। কিন্তু পরিবেশ অভিবাসন, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার-এসব বিষয়ে নীতির গতি ধীর। এখানেই ব্যানার্জি সতর্ক করেন,“যদি জলবায়ু নীতিতে মানুষের গল্প অনুপস্থিত থাকে, তবে প্রযুক্তি শুধু শক্তিশালীকে আরও শক্তিশালী করবে, দুর্বলদের নয়।” তথ্য আছে, প্রমাণ আছে, প্রযুক্তি আছে, অভাব শুধু মানুষের মানসিক প্রস্তুতির। তিনি বলেন, “আমাদের এক ভিন্ন ধরণের কল্পকাহিনীর প্রয়োজন, যা মানুষের চিন্তাভাবনা এবং মানবিক অনুভূতিকে আত্মকেন্দ্রিকতায় আচ্ছন্ন করবে না।”

 

সূত্র : Professor Spotlight on Anindita Banerjee: Leaning on the Humanities When Science is not Enough to Mitigate Climate Change By Natalie Monticello, Nov 18, 2019 6:52 pm.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty − eight =