জলের ধারে জমে থাকা কাদাকে আমরা অবহেলার চোখেই দেখি। কিন্তু জানা গেছে, সেই কাদাতেই লুকিয়ে আছে বৈদ্যুতিক পরিকাঠামোর ক্ষুদ্রতম নির্মাতারা – ব্যাকটেরিয়া। অণু-জীবনের এ এক রহস্যময় তারের-ইঞ্জিনিয়ারিং গিল্ড। নতুন গবেষণা বলছে, এরা নিকেল এবং জৈব যৌগ বুনে বানায় জীবন্ত বৈদ্যুতিক ন্যানো-তার। আর এটি আধুনিক জৈব বিদ্যুৎকে আশাতীতভাবে বদলে দিতে পারে। গবেষকদের দাবি, এটাই জীববিজ্ঞানে দেখা প্রথম ধাতব জৈব কাঠামো। ব্যাকটেরিয়ার এই তারগুলো কৃত্রিম ন্যানোতারের তুলনায় প্রায় শতগুণ বেশি পরিবাহী। অর্থাৎ, বায়ো-কম্পিউটিং, স্নায়বিক ইন্টারফেস, নিম্ন-শক্তির সেন্সর সর্বত্র এরা ভবিষ্যৎ বৈদ্যুতিক বিপ্লবের যন্ত্রাংশ হতে পারে। তবে বিষয়টি এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ। ডেনমার্কের আরহুস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রোমাইক্রোবায়োলজিস্ট লার্স পিটার নিলসেন বলছেন, “যদি এটি সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে আমরা ইলেকট্রন পরিবহনের জগৎকে নতুন করে আঁকতে বাধ্য হব।” ২০০৯ সালে আরহুস হারবারের কাদামাটিতে এই ব্যাকটেরিয়ার প্রথম দেখা মেলে। হাইড্রোজেন সালফাইড এদের মূল খাদ্য। মৃত্যুর গন্ধমাখা সেই গ্যাস মূলত পচনশীল জীবদেহ থেকে উঠে আসে। ব্যাকটেরিয়া সালফাইড থেকে ইলেকট্রন ছিনিয়ে নেয়, আর সেই ইলেকট্রন পাঠিয়ে দেয় কাদার উপরের স্তরের অক্সিজেন-সমৃদ্ধ অঞ্চলে। উচ্চ-শক্তির সালফাইড থেকে নিম্ন-শক্তির অক্সিজেন এই বৈদ্যুতিক ঢাল থেকেই তারা বেঁচে থাকার শক্তি সংগ্রহ করে। কিন্তু সমস্যা হল, সালফাইড থাকে গভীরে আর অক্সিজেন থাকে উপরে। তাদের টিকে থাকার প্রশ্নই তখন এই বিদ্যুৎবাহী পথ দাবি করে। তাই ব্যাকটেরিয়ার ঝাঁক নিজেদের কোষগুলিকে সারি, স্তর, এবং অণু-শৃঙ্খলে সাজিয়ে তৈরি করে এক দীর্ঘ জীবন্ত ইলেকট্রিক তার। অনেকগুলি কোষ মিলে তৈরি হয় যেন এক বিশাল মহাজীব। ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেরেক লাভলির ভাষায়, “জীবজগতে এমন সহযোগী বৈদ্যুতিক কাঠামো আমরা অন্য কোথাও দেখিনি। এগুলি পৃথিবীর স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে জন্ম নেওয়া নীরব বৈদ্যুতিক স্থপতি”। এ পর্যন্ত মেলা প্রায় ২৫,০০০ ব্যাকটেরিয়ার তৈরি, তারের দৈর্ঘ্য ৫ সেন্টিমিটার। অনুমান বলছে, কেবল এক বর্গমিটার কাদা-মাটিতে লুকিয়ে থাকতে পারে প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার জীবন্ত বৈদ্যুতিক তার। ভূগর্ভের রসায়ন বদলানো, পুষ্টিচক্র রূপান্তর, আয়ন পরিবহন বাড়ানো, এই তারগুলি ‘ ক্ষুদ্র রাসায়নিক চুল্লি’ হিসেবে এসব কাজ করে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তারগুলি কী দিয়ে বানানো? কেন তারা এত পরিবাহী? অ্যান্টওয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিপ মেইসমান দল নিয়ে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে দেখেন, তারটির গায়ে রয়েছে ডজনখানেক সূক্ষ্ম খাঁজ। প্রতিটি খাঁজে ৫০ ন্যানোমিটার পুরু পরিবাহী তন্তু রয়েছে। যা আসলে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বোনা অতি ক্ষুদ্র ফিতে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাকটেরিয়া কাদামাটির জলে ভেসে থাকা নিকেল আয়ন সংগ্রহ করে সালফারযুক্ত জৈব যৌগের সঙ্গে যুক্ত করে তৈরি করে ধাতব-জৈব প্লেট। সেই প্লেট স্তরে স্তরে সাজিয়ে তৈরি হয় ন্যানোরিবন। আর ফিতে বুনে তৈরি হয় নমনীয়, জৈব, অথচ অবিশ্বাস্য পরিবাহী তার। আমাদের ঘরের তামার তারের এক জৈব সংস্করণ। নিলসেনের মন্তব্য,“এটি বিবর্তনের ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষমতার এক স্তম্ভসম প্রমাণ।“ কৃত্রিম ন্যানোতার থাকলেও ব্যাকটেরিয়া-জাত ন্যানোরিবনের পরিবাহিতা তার শতগুণ। “এই ব্যাকটেরিয়া হয়তো আমাদের কৃত্রিম স্নায়ু, বায়ো-সেন্সর, এমনকি বাতাসের আর্দ্রতা থেকেও বিদ্যুৎ আহরণের পথ দেখাবে।“ অর্থাৎ, একদিন হয়তো ফোন চার্জ হবে নদীর ধারে বসে, কিংবা চিকিৎসা-যন্ত্রে যুক্ত হবে জৈব স্নায়ু-সংযোগ। কাদা-মাটির অন্ধকারেই হয়তো লেখা হচ্ছে আগামীর জৈব বৈদ্যুতিক সভ্যতার নকশা।
সূত্র : Metal scaffolds turns bacteria into live wires ; Science.org.
