পতঙ্গবৈচিত্র্যের অবক্ষয়: সম্ভাব্য ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত

পতঙ্গবৈচিত্র্যের অবক্ষয়: সম্ভাব্য ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ নভেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ইতিহাসে বহু বড় বিপর্যয় পেরিয়ে এসেছে বহু জীবন। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ক্রমশ একমত হয়ে বলছেন, পৃথিবী এবার ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে। অতীতে পৃথিবীতে পাঁচটি বৃহৎ গণবিলুপ্তি ঘটে গেছে, যেগুলো প্রধানত প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত হয়েছিল। তবে এবারের প্রধান চালিকা শক্তি মানবজাতি নিজেই। জাতিসংঘের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে—বিশ্বে প্রায় এক মিলিয়ন প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকির মুখে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পাখি, স্তন্যপায়ী কিংবা সরীসৃপ, কিন্তু এর আড়ালে সবচেয়ে নীরবে যে প্রাণীগোষ্ঠী হারিয়ে যাচ্ছে তা হলো পোকামাকড়। এরা এই আলোচনায় খুব কমই জায়গা পায়। যদিও অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের কাছে স্পষ্ট যে অসংখ্য পোকা আর দেখা যাচ্ছে না।

এই সংকটের প্রথম ইঙ্গিত আসে আমাদের দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণ থেকে, যাকে বলা হয় “উইন্ডশিল্ড ফেনোমেনন”/ গাড়ির সামনের কাঁচে পোকামাকড় লেগে থাকার ঘটনা। আগে রাতে দূরপাল্লার গাড়ি চলার পর সামনের কাঁচ ভরে যেত ছোট ছোট পোকামাকড়ে। আজ সেটি প্রায় অদৃশ্য। এই সাধারণ ঘটনাটিই বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কেন্দ্রে দাঁড় করায়: পোকামাকড়ের সংখ্যা কি তারমানে সত্যিই কমে যাচ্ছে? সন্দেহ জাগতেই জার্মানির ক্রেফেল্ড এনটোমোলজিক্যাল সোসাইটি তাদের ২৭ বছরের নজরদারির তথ্য বিশ্লেষণ করে জানায়—উড়ন্ত পোকামাকড়ের বায়োমাস/ জৈবভর ঋতুভেদে কমেছে ৭৬%, আর শুধুমাত্র গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে ৮২%। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এই গবেষণা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে।

ইংল্যান্ডের রথমস্টেড রিসার্চও ১৯৬০-এর দশক থেকে আলো ও সাকশন ট্র্যাপ ব্যবহার করে পতঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে আসছে। প্রায় ২৪ মিলিয়ন মথের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়—৪৭ বছরে মথের সংখ্যা ৩১% কমেছে। উপকূলীয় অঞ্চলে, শহুরে ও অরণ্যে এই পতন ছিল সবচেয়ে বেশি। এই দীর্ঘমেয়াদি তথ্য দেখায় যে পতঙ্গ বৈচিত্র্যের ক্ষতি বাস্তব ও উদ্বেগজনক। যদিও কিছু কৃষিজ এলাকা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল।

এর পরবর্তী সময়ে প্রায় ৩,৫০০ গবেষণা উঠে আসে। এই গবেষণাগুলো প্রকাশের পর ক্রমহ্রাসমান পোকামাকড়ের বাস্তব সংকট বোঝানোর জন্য গণমাধ্যমে “ইনসেক্ট আর্মাগেডন”/ ”ইনসেক্ট আপক্যালিপ্স” ধরনের শিরোনাম ছড়িয়ে পড়লেও, বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলেন সঠিক তথ্য ও পদ্ধতিগত গবেষণা জরুরি। পতঙ্গ হ্রাসের কারণ অনেক রকম: আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ, কীটনাশকপ্রধান কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন, শহরায়ন, ভূমি-ব্যবহার পরিবর্তন, আগ্রাসী প্রজাতি ও রোগজীবাণু। বিশেষ করে সংকীর্ণ বাসস্থান নির্ভর পতঙ্গেরা প্রথমেই টিকে থাকার লড়াইয়ে হার মানে।

ভারতে পতঙ্গবৈচিত্র্য নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা এখনো শুরু হয়নি। তবে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ যেমন- ফায়ারফ্লাই গণনা, মথ ও প্রজাপতি সমীক্ষা, ড্রাগনফ্লাই ট্র্যাকিং—কাজ করছে বটে, কিন্তু বড় আকারের তথ্যভান্ডার তৈরি হয়নি। তহবিলের অভাবে বিপুল সংখ্যক পতঙ্গ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা অজানাই রয়ে গেছে। শহরায়ন, আলোকদূষণ, আক্রমণকারী উদ্ভিদ এবং অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে পতঙ্গের আবাসস্থল দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। যেমনটা দেখা গেছে বেঙ্গালুরুর আশপাশে ডাং বিটলদের দ্রুত সংকোচনের ক্ষেত্রে।

প্রতি বছর পৃথিবীতে পতঙ্গ কমছে গড়ে ১–২% হারে। এর ফল সরাসরি পড়ছে খাদ্যশৃঙ্খলে—পাখি, ব্যাঙ, সরীসৃপ ও ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীরা খাদ্যের অভাবে বিপন্ন হচ্ছে। কিন্তু ইতিবাচক বিষয় হল পতঙ্গ অত্যন্ত অভিযোজনক্ষম জীব। প্রকৃতিকে একটু জায়গা দিলে এরা আবার ফিরে আসতে পারে। মানুষের ছোট ছোট পদক্ষেপ যেমন- স্থানীয় উদ্ভিদ রোপণ, বাগানকে প্রাকৃতিক রাখা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পরিহার, বিনাকারনে গাছ না কাটা , দূষণ কমানো ইত্যাদি পতঙ্গ পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনটা জার্মানির “থাউস্যান্ড গার্ডেনস—থাউস্যান্ড স্পিসিস” প্রকল্প দেখিয়েছে যে সঠিক সিদ্ধান্তে পরিবেশ দ্রুত পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।

পোকামাকড়ই প্রকৃতির ভিত্তি তারা মাটিকে উর্বর করে, বনকে শ্বাস দেয়, পরাগায়নে সাহায্য করে , খাদ্যজালের ভারসাম্য বজায় রাখে। ফলে তাদের পতন মানে আমাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হওয়া অবশ্যম্ভাবী ।

 

সূত্রঃ Are insects disappearing? Data from decades-long studies show steep declines in insects, threatening ecosystems and the birds, frogs, and plants that depend on them by Geetha Iyer, published on 3rd October, 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × five =