তপ্ত প্রস্রবণ আর ঠাণ্ডা মিথেনের সহাবস্থান!

তপ্ত প্রস্রবণ আর ঠাণ্ডা মিথেনের সহাবস্থান!

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২ ডিসেম্বর, ২০২৫

পাপুয়া নিউ গিনির উপকূলের গভীর সাগরতলে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এক অভূতপূর্ব পরিবেশ। যেখানে জ্বলন্ত তপ্ত প্রস্রবণ / হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট ও ঠান্ডা মিথেন নিঃসরণ একই স্থানে পাশাপাশি অবস্থান করছে। সমুদ্রতলের মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরে এই দুই বিপরীতধর্মী প্রক্রিয়ার সমসাময়িক উপস্থিতি আগে কখনো দেখা যায়নি। আর এই অদ্ভুত রাসায়নিক পরিবেশই জন্ম দিয়েছে এক প্রাণচঞ্চল গভীর সাগর রাজ্য, যেখানে টলটলে জলের তলায় গুচ্ছ গুচ্ছ ঝিনুক বা শামুক(মাশেল), লাল টিউব ওয়ার্ম, ছুটন্ত চিংড়ি, ক্ষুদে অ্যাম্ফিপড আর বেগুনি সাগর-শসা একসাথে ভিড় জমিয়েছে—সম্ভবত এরা অনেকেই নতুন প্রজাতি।

এই বিশেষ উষ্ণ প্রস্রবণের ক্ষেত্রটি প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে লিহির দ্বীপের কাছাকাছি সামুদ্রিক পাহাড়ের ঢালে, প্রায় ১,৩০০ মিটার গভীরে অবস্থিত। ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্ট’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষনা প ত র টি জানায়, গবেষণার কাজের জন্য তৈরি জার্মান জাহাজ সোনি–এর SO299 অভিযানে রওনা দেওয়া আর ও ভি কিয়েল 6000 এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রথম পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করে। এই অভিযানের প্রধান বিজ্ঞানী ড. ফিলিপ ব্র্যান্ডল বলেন, একই জায়গায় তপ্ত ভেন্টের পাশে ঠান্ডা গ্যাসের ফোয়ারা—এমন ঘটনা তাঁরা আগে কখনো দেখেননি ।

এই অস্বাভাবিকতার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন সামুদ্রিক পাহাড়গুলোর ভূগঠনের বিশেষত্ব। এধরনের পাহাড়ের নীচে রয়েছে জৈবসমৃদ্ধ পুরু তলানি-স্তর। নীচ থেকে উঠে আসা ম্যাগমা এই স্তর গরম করে প্রচুর মিথেন ও হাইড্রোকার্বন তৈরি করে। একইসঙ্গে ম্যাগমার তাপই গভীর থেকে খনিজসমৃদ্ধ তরলকে উপরে ঠেলে পাঠায়, যা সমুদ্রতলে তপ্ত জল হিসেবে বেরিয়ে আসে। ফলে একই ফাটল দিয়ে একদিকে গরম তরল, অন্যদিকে ঠান্ডা গ্যাস বেরিয়ে এসে গড়ে তোলে এক বিরল দ্বৈত ব্যবস্থা,যা গভীর সমুদ্রে এক বিরলতম চিত্র।

এই অনন্য প্রক্রিয়া জন্ম দিয়েছে গভীর সমুদ্রের এক ব্যতিক্রমী বাস্তুতন্ত্র, ঘটেছে প্রানবৈচিত্র্যের বিস্ফোরণ। পাথরগুলো এত ঘনভাবে ঝিনুক / শামুক (মাশেল) আর অন্যান্য প্রাণীতে ভরপুর যে অনেক জায়গায় শিলা একেবারেই দেখা যায় না। মাশেলের আধিক্যের কারণে স্থানীয় টোক পিসিন ভাষায় এই ক্ষেত্রটির নাম রাখা হয়েছে ‘কারামবুসেল’, অর্থাৎ—“মাশেলের জায়গা।”

এখানকার শিলায় সোনা, রূপা, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি ও পারদ প্র ভ্রি টী ধাতুর অস্তিত্ব প্রমাণ করে—অতীতে এখানে তীব্র তাপমাত্রার জলীয় কার্যকলাপ ছিল। যদিও বর্তমানে তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা, তবুও গ্যাসের অস্বাভাবিক মিশ্রণ ভূ-রাসায়নিক পরিবেশকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছে।

তবে এই কারামবুসেল অঞ্চল ইতিমধ্যেই মানবিক হস্তক্ষেপের হুমকির মুখে। লিহিরের লাডোলাম স্বর্ণখনির বর্জ্য নির্গমন এবং সমুদ্রতলের খনিজ অনুসন্ধানের নতুন লাইসেন্স এই বাস্তুতন্ত্রকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গবেষকরা সে কারণে, কারামবুসেল অঞ্চলকে সুরক্ষিত করতে জরুরি ভিত্তিতে আরও অনুসন্ধান, সচেতন পরিকল্পনা ,প্রতিবেশগত সুরক্ষা এবং সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

ড. ব্র্যান্ডলের বলেন , কারামবুসেল এমন এক অনবদ্য জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার, একে সত্যি বলতে গভীর-সমুদ্র সম্পদ বললেও ভুল হবে না। এটিকে এখনই রক্ষা করতে না পারলে এটি মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থের চাপে হারিয়ে যাবে চিরতরে।

 

সূত্র : Scientists discover a hidden deep sea hotspot bursting with life by Philipp A. Brandl, Sylvia G. Sander,et.al; Materials provided by Helmholtz Centre for Ocean Research Kiel (GEOMAR), 26th November,2025.

DOI: 10.1038/s41598-025-17192-x

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 + ten =