আমরা ঠিক যতটা ভাবি, তার চেয়েও বেশি নাটকীয়ভাবে সারা জীবন ধরে পালা বদল করে আমাদের মস্তিষ্ক। জন্ম থেকে ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের শেখার ক্ষমতা, যুক্তিবোধ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক স্থিতি— প্রতিটি প্রক্রিয়ারই গণ্ডি ছন্দে বাঁধা। কিন্তু এই ছন্দের উৎস কোথায় এবং সম্পূর্ন জীবদ্দশায় কিভাবেই বা তা নির্ভুল ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়? নতুন গবেষণা বলছে, এর উত্তরে লুকিয়ে আছে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোর সংযোগের চারটি বড় রূপান্তরে। যেগুলো ঘটে ৯, ৩২, ৬৬ ও ৮৩ বছর বয়সে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যালেক্সা মাউসলি ও তাঁর দল। তাঁরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩৮০০ জন মানুষের এমআরআই স্ক্যান বিশ্লেষণ করেছেন—যাঁদের বয়স ছিল নবজাতক থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত। এসব স্ক্যান নিউরোইমেজিং প্রকল্প থেকে নেওয়া, যেখানে সাধারণত কোনো স্নায়বিক বা মানসিক ব্যাধিযুক্ত মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
এ যেন জীবনের সঙ্গে মস্তিষ্কের এক গোপন সমঝোতা: প্রতিটি পর্যায়ে এটি নতুন করে নিজেকে সাজায়, ভেঙে গড়ে ওঠে, প্রস্তুত হয় নতুন বাস্তবতার জন্য।
এবার দেখা যাক সেই চার রুপান্তরে কিভাবে কি হয়-
১) শৈশব: সম্ভাবনার বিস্ফোরণ (জন্ম–৯ বছর)
জীবনের শুরুর এই সময়ে মস্তিষ্ক যেন নিজেকে অবারিত সম্ভাবনার জন্য ছড়িয়ে দেয়। সংযোগগুলো দীর্ঘ ও জটিল হয়, তথ্যপ্রবাহ ধীর হলেও উদ্দেশ্য স্পষ্ট—শেখার ভিত্তি তৈরি। শিশুর মস্তিষ্কে যে অগণিত সংযোগ তৈরি হয়, সেখান থেকেই বেছে নেওয়া হবে ভবিষ্যতের দক্ষতাগুলো। এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অপ্রয়োজনীয় অংশ ছাঁটাই হয়।
২) যৌবন ও তৎপরবর্তী পর্ব: দক্ষতার নির্মাণ (৯–৩২ বছর)
কিশোরবয়সের হরমোন পরিবর্তন শুধুই শারীরিক রূপান্তর নয়—এটি মস্তিষ্কের ভেতরেও এক বিপ্লব ঘটায়। সংযোগ ছোট হয়, কার্যকর হয়, তথ্য চলাচল দ্রুত হয়। এই সময়েই গড়ে ওঠে আমাদের বিচারক্ষমতা, সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। জীবনের দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মস্তিষ্ক তৈরি করে সবচেয়ে শক্ত ভিত্তি।
৩) মধ্যবয়স: ভারসাম্য ও ক্লান্তির সন্ধিক্ষণ (৩২–৬৬ বছর)
এটি মস্তিষ্কের দীর্ঘতম স্থিতিশীল পর্ব। কিন্তু নিঃশব্দে এখানে শুরু হয় ধীর অবনতি। কেরিয়ার, পরিবার, চাপ—সব মিলিয়ে মানসিক ভার বাড়ে। শরীরের স্বাভাবিক বার্ধক্যও থমথমে প্রভাব ফেলে স্নায়ু সংযোগে। যেন মস্তিষ্ক কিছুটা বিরতি চায়, আবার এগিয়ে চলারও প্রয়োজন অনুভব করে।
৪) প্রবীণ বয়স: সংযোগের সংকোচন (৬৬–৮৩ বছর)
এই সময় একই অঞ্চলের সংযোগ টিকে থাকে, কিন্তু দূরবর্তী অংশের সঙ্গে যোগাযোগ দুর্বল হতে থাকে। স্মৃতি ঝাপসা হওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া—এই লক্ষণগুলো ঠিক এই পর্যায়েরই প্রতিফলন। ডিমেনশিয়ার ঝুঁকিও এই সময় থেকেই স্পষ্ট।
অন্তিম অধ্যায়: নির্ভরতার পুনর্গঠন (৮৩–৯০ বছর)
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মস্তিষ্ক বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়—সব সংযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই এটি নির্ভর করে কিছু কিছু মূল অঞ্চলের ওপর। অর্থাৎ সব সংযোগ বজায় রাখার মতো পর্যাপ্ত শক্তি থাকে না, তাই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের উপর নির্ভরতা বাড়ে। এটি মস্তিষ্কের শক্তি ও সম্পদের সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত দেয়।
মস্তিষ্কের পরিবর্তন কোনো বিপর্যয় নয়, বরং জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া। এখন দরকার আরও বিস্তারিত গবেষণা, যাতে বোঝা যায়—জাতি ও অঞ্চলভেদে এই স্বাভাবিক ছন্দ কোথায় ভেঙে যায় মানসিক রোগ বা ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে।
সূত্র : Your brain undergoes four dramatic periods of change from age 0 to 90 By Carissa Wong, published in Nature Communications, 25th November, 2025.
DOI: 10.1038/s41467-025-65974-8
